সুমন ঘোষ, খড়্গপুর
খড়্গপুর আইআইটি’তে পর পর ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার জেরে এ বার পড়ুয়াদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন কর্তৃপক্ষ। এ ধরনের ঘটনা রুখতে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে সম্পর্কে পড়ুয়াদের কাছ থেকেই পরামর্শ চাইলেন তাঁরা।
জানা গিয়েছে, সোমবার ক্যাম্পাসে এই বৈঠক ডাকেন ভারপ্রাপ্ত ডিরেক্টর অমিত পাত্র। সেখানে কর্তৃপক্ষের অনুরোধে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দিয়েছেন পড়ুয়ারা। এক, পড়াশোনা ও মানসিক স্বাস্থ্যের স্বার্থে সিনিয়র ও জুনিয়র পড়ুয়াদের মধ্যে দূরত্ব ঘোচানো। দুই, টানা ছুটি বা অবকাশের সময়ে বিশাল ক্যাম্পাস জুড়ে থাকা অল্প সংখ্যক পড়ুয়াকে এক জায়গার রাখার ব্যবস্থা করা, যাতে তাঁরা একাকীত্ব বোধে না ভোগেন।
তিন, দ্বিতীয় বর্ষে হস্টেলে ঘর বদলের ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের পছন্দকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। জানা গিয়েছে, পড়ুয়াদের এই তিনটি প্রস্তাবই মেনে নিয়েছেন আইআইটি কর্তৃপক্ষ।
বৈঠকের শেষে ভারপ্রাপ্ত ডিরেক্টর বলেন, ‘এ বার থেকে এই পদ্ধতি মেনেই চলা হবে। ছাত্রছাত্রীদের সব সময় কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে রাখলেই যে সব সময় ভালো হবে এমন তো নয়। অনেক সময় উল্টোও হয়। তাই ছাত্রছাত্রীদের দাবিগুলি, যা মান্যতা দিলে ভালো হবে, সেগুলি আমরা মান্যতা দেব।’
এ দিকে, ক্যাম্পাসে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনার রহস্য এখনও কাটল না। যে তরুণীর সঙ্গে শেষবার ভিডিয়ো কলে কথা হয়েছিল বলে পুলিশের দাবি, তাঁর সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত কিছুই জানা যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, ওই তরুণীর সঙ্গে মৃত ছাত্র আসিফ কামারের কী সম্পর্ক ছিল, শেষবার কী কথা হয়েছিল, তা জানার চেষ্টা চলছে।
অন্য দিকে, মৃত ছাত্রের পরিবারের পক্ষ আলাদা করে থানায় কোনও অভিযোগও জানানো হয়নি। রাজ্য পুলিশের তদন্তে আস্থা রেখে মৃতের দাদা নাদিম কামার বলেন, ‘পুলিশ যে তদন্ত করছে তাতে আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। আমাদের কোনও অভিযোগ নেই।’
এ দিন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে মৃত ছাত্রের ময়নাতদন্তও হয় ভিডিয়োগ্রাফির মাধ্যমে। তারপর দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, আসিফেরা ছয় ভাই ও দুই বোন। বাবা কামরুদ্দিন কামার ও মা সাবিহা, দু’জনেই স্কুলশিক্ষক ছিলেন। ছেলেদের মধ্যে চারজনই ইঞ্জিনিয়ার। একজন ডাক্তারি পড়ছেন। সবার ছোট আসিফ একমাত্র আইআইটিতে সূযোগ পেয়েছিলেন।
আসিফের আত্মহত্যার ঘটনার পর সোমবার দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে খড়্গপুর আইআইটিতে। কখনও অধ্যাপকদের নিয়ে, কখনও কর্মীদের নিয়ে। আবার কখনও ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। আইআইটি সূত্রে জানা গিয়েছে, আইআইটি কর্মীদের আরও সজাগ থাকার কথা বলা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের আচরণেও এ বার রাশ টানার প্রসঙ্গও উঠেছে প্রশাসনিক বৈঠকে।
কারণ, এই ঘটনার জেরে ভয়ে অনেক অভিভাবক আইআইটির হস্টেল থেকে ছেলেমেয়েদের বাইরে রাখার কথাও ভাবছেন। পাশপাশি, নতুন শিক্ষাবর্ষে যাঁরা ভর্তি হবেন তাঁদের ক্ষেত্রেও হয়তো বাইরে বাড়ি ভাড়া নেওয়ার প্রবণতা বাড়বে বলেই আশঙ্কা। এ দিন স্থানীয় লোকজন মোমবাতি জ্বালিয়ে পুরীগেটে ছাত্রমৃত্যুর প্রতিবাদ জানান। সেখানে ছিলেন খড়্গপুর পুরসভার কাউন্সিলার অপূর্ব ঘোষ। তিনি বলেন, ‘বার বার ছাত্রমৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ বাড়ছে অভিভাবকদের মধ্যে। নতুবা অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের ছাত্রাবাসে রাখতে ভরসা পাবেন না। যে কোনও মূল্যে এটা বন্ধ করতে হবে।’
অভিভাবকদের মধ্যে এই ভরসা জোগানোর প্রশ্নেই এ দিন পড়ুয়াদের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারপ্রাপ্ত ডিরেক্টর অমিত পাত্র। বৈঠকের আলোচ্য বিষয়বস্তুও পড়ুয়াদেরই তৈরি করতে বলা হয়েছিল। ডিরেক্টর জানান, ছাত্রছাত্রীরা তিনটি মূল পয়েন্টের কথা উল্লেখ করেছেন। এক, র্যাগিংয়ের ভয়ে বা অন্য কোনও কারণে সব সময় জুনিয়রদের সঙ্গে সিনিয়রদের দূরত্বে রাখা ঠিক হবে না।
মাঝেমধ্যেই দু’পক্ষকে এক জায়গায় বসিয়ে আলোচনার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। সেখানে জুনিয়র ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের সমস্যার কথা সিনিয়রদের বলতে পারবেন। আবার সিনিয়র ছাত্রছাত্রীরা কী ভাবে বিভিন্ন সমস্যা কাটিয়ে এক সেমেস্টার থেকে পরবর্তী সেমেস্টারে উত্তীর্ণ হয়েছেন, প্রথম থেকে তৃতীয় বর্ষে পৌঁছেছেন, সেটা বলবেন। এতে সুসম্পর্কের পাশাপাশি ভ্রাতৃত্ববোধও গড়ে উঠবে। তাতে পঠন-পাঠনেও সুবিধে হবে।
দ্বিতীয়ত, গ্রীষ্মের ছুটিতে অনেকেই বাড়ি চলে যান। একটি হলে ৮০০ জনের মধ্যে হয়তো ৫০ জন পড়ুয়া থাকেন ইন্টার্নশিপ বা অন্য কোনও কাজে। দেখা যায়, একজন এক প্রান্তে রয়েছেন, তো অন্যজন অন্য প্রান্তে। সেই দূরত্ব কাটাতে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় থেকে যাওয়া ছাত্রদের পাশাপাশি রাখার ব্যবস্থা করা। যাতে একাকীত্ব কাটে। তৃতীয়ত, প্রথম বর্ষের শেষে দ্বিতীয় বর্ষে হস্টেলে ঘর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ওই পড়ুয়াদের পছন্দকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এখন তাঁদের আবেদন করতে হয়। এ বার থেকে ছাত্রছাত্রীদের পছন্দ আগে থেকে জেনে নিতে হবে। জানা গিয়েছে, কর্তৃপক্ষ পড়ুয়াদে এই তিনি প্রস্তাবই মেনে নিয়েছে।