সুনন্দ ঘোষ
— ‘মাথা নামিয়ে পাশ থেকে খানিকটা নিচু স্বরে অফিসার বললেন, ম্যাডাম, আজ বোধহয় ফেরা যাবে না। পাকিস্তান অ্যাটাক করে দিয়েছে। এখান থেকে কোনও ফ্লাইট টেক–অফ করতে পারবে না। দিল্লি থেকে অর্ডার এসেছে, রানওয়ের সমস্ত লাইট অফ করে দিতে হবে। গাড়ি থেকে ভিআইপি রুমে হাঁটার পথে থমকে গেলেন ম্যাডাম। ঘুরে দাঁড়ালেন। সামনে তখন আমরা হাতে–গোনা কয়েকজন। সেই অফিসারের চোখের দিকে চোখ রেখে শীতল গলায় মিসেস গান্ধী বললেন, আমি যাব। আই অ্যাম গোয়িং।’ মিসেস গান্ধী মানে ইন্দিরা গান্ধী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
চেয়ারে আয়েশ করে বসে ১৯৭১–এর বাংলাদেশ যুদ্ধের গল্প শোনাচ্ছিলেন অমলেন্দু। ৫৪ বছর আগের কথা। তবুও ছবির মতো প্রতিটি দৃশ্য উঠে আসছিল তাঁর বর্ণনায়। সেটা ছিল ৩ ডিসেম্বর। কাকতালীয় ভাবে সে দিনই ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায়। তাঁকে নিয়ে এসেছে বায়ুসেনার স্পেশাল ফ্লাইট। শহরের কাজ সেরে দিল্লি ফেরার কথা ম্যাডামের।
তার আগে, সে দিনই আকাশপথে হামলা করে দিয়েছে পাকিস্তানি বায়ুসেনা। কলকাতার আকাশের গা–ঘেঁষে উড়ছে পাকিস্তানি ফাইটার জেট। দিল্লি থেকে ডিরেক্টর জেনারেল অফ সিভিল এভিয়েশন (ডিজিসিএ) ক্যাপ্টেন জি সি আরিয়া হটলাইনে কলকাতার এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)–কে ধরে বললেন, ‘ডু নট অ্যালাউ প্রাইম মিনিস্টার টু টেক অফ। পাকিস্তান হ্যাজ় স্টার্টেড বম্বিং।’
বলে চলেন অমলেন্দু — ‘বুঝুন অবস্থা। এ অবস্থায় প্রাইম মিনিস্টারের ফ্লাইট ওড়ার পারমিশন কে দেবে? অথচ গোঁ ধরে বসেছেন, তিনি দিল্লি যাবেনই। আর ওইরকম ব্যক্তিত্ব। ওই কম্যান্ড। সামনে দাঁড়ালে গলা শুকিয়ে যাবে। আমি যাব, এইটুকু বলে মিসেস গান্ধী, ইস্টার্ন কম্যান্ডের জিওসি–ইন–সিকে নিয়ে ভিআইপি রুমে গিয়ে বসলেন। এগিয়ে এলেন ম্যাডামের স্পেশাল ফ্লাইটের পাইলট। আমাকে ডেকে বললেন, আপনি ফলো মি দিতে পারবেন? তখন সন্ধে নেমে গিয়েছে। আমি একটু চিন্তা করে নিয়ে বললাম পারব।’
‘ফলো মি’ আদতে একটি জিপ। বিমানবন্দর কতৃর্পক্ষের থাকে। কোনও বিমানকে ট্যাক্সি বে এবং রানওয়েতে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যায় সে। এখনও এই জিপ ব্যবহার করা হয়। যার পিছনে বড় বড় করে লেখা ‘ফলো মি’।
সে দিন সেই ‘ফলো মি’ জিপে অমলেন্দু নিজে ছিলেন। ড্রাইভার চালাচ্ছিলেন। আগে আগে ধীর গতিতে যাচ্ছিল সেই ‘ফলো মি’ জিপ। হেডলাইট অফ। বিমানবন্দরের প্রতিটি বে চেনা, অভিজ্ঞ ‘ফলো মি’ জিপের চালকের। অমলেন্দু বললেন, ওই ঘুটঘুটে অন্ধকারেও তাই অসুবিধা হচ্ছিল না ড্রাইভারের। শুধু টিমটিম করে জ্বলছিল জিপের ব্যাকলাইট। আর সেই ব্যাকলাইটকে ফলো করে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে বায়ুসেনার বিমান আসছিল পিছনে।
এখানেই গল্পের শেষ নয়। অমলেন্দু যোগ করেন, ‘রানওয়ের যে প্রান্ত থেকে ম্যাডামের ফ্লাইটের টেক–অফ করার কথা ছিল, সেই পর্যন্ত তাকে ‘ফলো মি’ জিপ দিয়ে পৌঁছে দিলাম আমরা। আগেই পাইলটকে আমরা বলেছিলাম, শুধু রানওয়ে লাইট নয়, সমস্ত নেভিগেশনাল এইডও (যেগুলো বিমানকে রানওয়েতে নামা–ওঠার সময়ে সাহায্য করে) তো সুইচ অফ করতে হয়েছে। সেগুলো অন থাকলে কলকাতা বিমানবন্দরের সঠিক অবস্থান জেনে যাবে শত্রুপক্ষ। অ্যাটাক করতে পারে। পাইলট বলেছিলেন, নেভিগেশনাল এইড ছাড়াই তিনি উড়ে যাবেন।’
কিন্তু তখন তো রানওয়ে অন্ধকারে ঢাকা। কী করে টেক অফ করবে ফ্লাইট? পাইলট অমলেন্দুদের রিকোয়েস্ট করেছিলেন, তিনি রানওয়ের একদিকে থাকবেন, আর ‘ফলো মি’ জিপ নিয়ে অমলেন্দুরা রানওয়ের অন্যদিকে চলে যাবেন। তারপরে জিপের মুখ প্লেনের দিকে ঘুরিয়ে জিপের হেডলাইট বার কয়েক ব্লিঙ্ক করবেন। যার মানে হেডলাইট একবার করে জ্বালিয়ে নিভিয়ে দেবেন। দূর থেকে সেই আলোর ঝলকানি দেখে রানওয়ের অন্য প্রান্তের দূরত্ব মেপে নেবেন বায়ুসেনার পাইলট।
অমলেন্দুর কথায়, ‘এরকম বার কয়েক ব্লিঙ্ক করার পরে দেখলাম এয়ারবোর্ন হয়ে গিয়েছে প্রাইম মিনিস্টারের ফ্লাইট। রানওয়ের এক প্রান্ত থেকে আমাদের জিপের হেডলাইট দেখে রানওয়ের লেংথ আন্দাজ করে নিয়ে সেই মতো টেক–অফ করে গিয়েছিলেন পাইলট।’
কলকাতার পরেই গয়ার কাছে এটিসি ছিল। ওয়ারলেস কমিউনিকেশন–এর মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে ফ্লাইট সেফ জ়োনে পৌঁছে যেতেই সেখান থেকে বার্তা আসে, ‘অপারেশন নর্মাল’। দিল্লি ফিরে সেই রাতেই অফিশিয়ালি যুদ্ধ ঘোষণা করেন মিসেস গান্ধী।