সরকারি উদ্যোগে প্রথম বিনামূল্যে ওষুধ পেল এসএমএ আক্রান্ত দুই শিশু
আনন্দবাজার | ০৭ মে ২০২৫
গত এক দশকেরও কিছু বেশি সময় ধরে এ দেশে বার বার চর্চায় উঠে এসেছে বিভিন্ন বিরল রোগের নাম। রোগীদের পরিবারের তরফে আবেদন করা হয়েছে, বিদেশে আবিষ্কৃত চিকিৎসা প্রক্রিয়া এ দেশে কার্যকর করার ক্ষেত্রে লাল ফিতের ফাঁস কমানো হোক, সরকারের আর্থিক সাহায্য মিলুক, বিরল রোগের চিকিৎসায় উপযুক্ত পরিকাঠামো এবং জাতীয় নীতি তৈরি হোক। গত কয়েক বছরে বিরল রোগ নিয়ে যে সরকারি দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে, তা মানছে বিরল রোগের সঙ্গে লড়াই করা পরিবারগুলিও।
এ বার বিরল রোগের চিকিৎসার সেন্টার অব এক্সেলেন্স, এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে রাজ্য সরকারের ‘হেল্থ স্কিম’ মারফত ওষুধ পাচ্ছে স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফি (এসএমএ) আক্রান্ত দু’টি শিশু। এক মাস থেকে চার বছর বয়সের মধ্যে আরও চার জন এসএমএ আক্রান্ত শিশুও ওই ওষুধ পাবে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরল রোগের তহবিল থেকে। তাদের মধ্যে একটি শিশু নদিয়ার এবং বাকি তিন জন উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে ওষুধ পেতে আরও একাধিক শিশু এসএমএ রোগীর মূল্যায়ন সেরেছেন চিকিৎসকেরা। চলতি বছরেই তারা ওষুধ পাবে। বিরল রোগ সম্পর্কে দুই সরকারের এই ইতিবাচক মনোভাবে আশান্বিত দীর্ঘদিন ধরে বিরল রোগের চিকিৎসা করা চিকিৎসক এবং রোগীদের অভিভাবকদের সংগঠনগুলিও।
সারা বিশ্বে হাজার সাতেকেরও বেশি প্রকৃতির বিরল রোগের সন্ধান মিলেছে। অটোইমিউন ডিজ়অর্ডার, মেটাবলিক ডিজ়অর্ডার, জিনঘটিত বিভিন্ন রোগ, স্নায়ুর কোনও রোগের মতো একাধিক ধরনের হতে পারে এই বিরল রোগ। এ দেশে কম করে সাত কোটি মানুষ বিরল রোগে আক্রান্ত। যার মধ্যে বহু রোগের কোনও চিকিৎসা নেই। নিরন্তর গবেষণার পরে কিছু কিছু রোগের চিকিৎসা শুরু হয়েছে বা হচ্ছে। তবে সেই খরচ আকাশছোঁয়া। আর যে সব ক্ষেত্রে চিকিৎসা নেই, এমন বহু বিরল রোগে আক্রান্তের কষ্ট লাঘব করতে আনুষঙ্গিক শারীরিক সমস্যার প্রতিকারে নজর দেওয়াই চিকিৎসকদের মূল লক্ষ্য থাকে।
বিরল রোগে আক্রান্তদের পরিবারের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে ২০২১ সালে এ দেশে কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করে ন্যাশনাল পলিসি ফর রেয়ার ডিজ়িজ় (এনপিআরডি)। বিরল রোগের নির্ণয়, পরিষেবা প্রদান, গবেষণা, চিকিৎসা সংক্রান্ত নীতি তৈরি করাই যার লক্ষ্য। কেন্দ্রের এনপিআরডি-র অন্তর্গত ক্রাউড ফান্ডিং পোর্টাল তৈরি হয়েছে দেশের ১২টি উৎকর্ষ কেন্দ্রে। তারই একটি এসএসকেএম। সেখানে একটি বিরল রোগের ক্লিনিকও চলে।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিরল রোগের পোর্টালে নথিভুক্ত হওয়া রোগীদের নামের পাশে তাঁর রোগের বিস্তারিত বিবরণ থাকবে। ক্রাউড ফান্ডিং তহবিলে টাকা দিতে হলে নির্দিষ্ট রোগীকে ইচ্ছুক দাতা অর্থসাহায্য পাঠাতে পারেন। সেই টাকায় নির্দিষ্ট রোগী, অর্থাৎ যাঁকে টাকা দান করা হল, তাঁর জন্য ওষুধ অথবা বিশেষ যন্ত্র কিনতেও খরচ করা যেতে পারে।
সেন্টার অব এক্সেলেন্স ফর রেয়ার ডিজ়িজ়, এসএসকেএমের নোডাল অফিসার সুচন্দ্রা মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, সেখানে আসা রোগীদের হাসপাতালের নিজস্ব রেজিস্টারে নাম নথিভুক্ত করা থাকে। পরে রেজিস্ট্রেশন হওয়া রোগীর নাম তোলা হয় পোর্টালে। তাঁদের অনেকের রোগের ওষুধ না থাকলেও আনুষঙ্গিক সমস্যায় পরিষেবা দেয় হাসপাতাল। যেমন, রোগীর প্রয়োজন বুঝে বিভিন্ন রকমের প্রতিষেধক, ফিজ়িয়োথেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, স্নায়ু, দাঁতের চিকিৎসা চলে।
তবে এসএমএ, ডুসান মাস্কুলার ডিস্ট্রফি, গসারের মতো কয়েকটি বিরল রোগ প্রতিরোধ করা যায়। কিছু ক্ষেত্রে শিশুর জন্মের আগে পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায়, সে বিরল রোগে আক্রান্ত কিনা। সেই মতো প্রস্তুতি নিতে পারেন পরিবার ও চিকিৎসক। সুচন্দ্রা বলেন, ‘‘অন্তঃসত্ত্বার অ্যামনিয়োটিক ফ্লুইড পরীক্ষা করে বা মায়ের প্লাসেন্টা বা ভ্রূণের কোষ থেকে নমুনা নিয়ে সিভিএস পরীক্ষা করে জানা যায়, গর্ভস্থ শিশু বিরল রোগের শিকার কিনা। এই পরীক্ষাও এসএসকেএমে বিনামূল্যে করা হবে। তার জন্য যন্ত্র কেনার প্রক্রিয়া চলছে।’’ আবার জন্মের পরে যদি শিশুর কোনও লক্ষণ দেখে মনে হয়, এসএমএ বা ডিএমডি-র মতো বিরল রোগ আছে, তখন রোগ নির্ধারণের সেই পরীক্ষা এসএসকেএমে বিনামূল্যে হয়।
কিয়োর এসএমএ ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা মৌমিতা ঘোষ বলেন, ‘‘সরকার ও সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে। বিরল রোগের চিকিৎসায় বরাদ্দ সরকারি অর্থ প্রথম বার দেওয়া হল। যৌথ প্রচেষ্টায় এটা ঐতিহাসিক জয়। সরকারি চিকিৎসক ও আমাদের সংগঠনের মতো বিরল রোগীর অভিভাবকদের একাধিক সংগঠনের নিরন্তর প্রয়াসের ফল। আগামী দিনে আরও অনেক শিশু যাতে চিকিৎসা পায়, সেই চেষ্টা চালিয়ে যাব।’’