এই সময়: বিভাগীয় সমন্বয় নেই, সেই কারণেই কি শহরজুড়ে চলা রুফটপ ক্যাফে, রেস্তোরাঁ নিয়ে নীতির কোনও স্পষ্টতা নেই? এমনই গুঞ্জন শুরু হয়েছে কলকাতা পুরসভার অন্দরে। কারণ রুফটপ রেস্তোরাঁ, ক্যাফে চালু করা এবং তা চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে সম্পর্ক রয়েছে পুরসভার তিনটি বিভাগের। ট্রেড লাইসেন্স, বিল্ডিং এবং রাজস্ব। এই তিন বিভাগের ভূমিকাই প্রশ্নের মুখে।
পার্ক স্ট্রিট ও সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে দু’টি রুফটপ রেস্তোরাঁ ভাঙতে গিয়েছিল পুরসভা। এর জেরে রুফটপ ক্যাফে, রেস্তোরাঁর মালিকরা পুরসভার বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হন। সম্প্রতি বড়বাজারের মেছুয়ায় একটি হোটেলে আগুন লেগে ১৪ জনের মৃত্যু হয়। তার পরই কলকাতায় রুফটপ ক্যাফে রুখতে সক্রিয় হয়ে ওঠে পুরসভা।
এতে প্রশ্ন ওঠে, আগুন লাগল হোটেলে, পুরসভা কেন রুফটপ রেস্তোরাঁ, ক্যাফে ভাঙতে সক্রিয় হলো? পুরসভার যুক্তি ছিল, বিল্ডিংয়ের ছাদ কোনও ভাবেই আটকানো যায় না। কারণ এটি কমন প্যাসেজ। তাই ছাদ আটকানো ‘বেআইনি’। এই যুক্তিকে খণ্ডন করে ফের প্রশ্ন ওঠে, ২০০১–এর পর থেকেই কলকাতা শহরে বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের ছাদে রুফটপ রেস্তোরাঁ, ক্যাফে তৈরি হতে শুরু করে।
তা হলে কেন এত দিন এই ‘বেআইনি কারবার’ দেখেও পুরসভা চোখ বুজে রইল? কলকাতা হাইকোর্টেও রুফটপ ক্যাফে ভাঙা নিয়ে ধাক্কা খেয়েছে পুরসভা। মঙ্গলবার কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কলকাতার কোনও রুফটপ ক্যাফে, রেস্তোরাঁ ভাঙা যাবে না।
পুরসভার একাধিক আধিকারিক জানিয়েছেন, কলকাতায় কোনও ব্যবসা করতে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। সেই লাইলেন্স নিয়ে ঠিক কী রকমের ব্যবসা, কোথায়, কী ভাবে হচ্ছে—তাতে নজরদারি চালানোর পরিকাঠামোই নেই পুরসভার। এমনও নজির রয়েছে, যেখানে শুধু হোটেল ব্যবসার নামে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে হুক্কা বার, পানশালা বা রুফটপ রেস্তোরাঁ, ক্যাফে চলছে।
সেই লাইসেন্স বছরের পর বছর রিনিউও হয়ে যাচ্ছে। লাইসেন্স রিনিউ করার পরে ব্যবসায়ীরা কর দেন। রাজস্ব বাড়ে পুরসভার। এখানেই শেষ নয়, রেসিডেন্সিয়াল প্রপার্টিও দেদার ব্যবহার হচ্ছে কমার্শিয়াল কাজে।
পুরসভার বিল্ডিং আইন অনুযায়ী, কোনও বাড়ি বা আবাসনের ছাদ আটকে রাখা যায় না। বাড়ির ছাদ বিক্রিও করা যায় না। অথচ অনেক সময়েই বাড়ির ছাদ হাতবদলের অভিযোগ ওঠে। ছাদ আটকে দেদার ব্যবসাও হচ্ছে শহর জুড়ে। এ নিয়ে নজরদারি চালানোর কথা বিল্ডিং বিভাগের। ওই বিভাগের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন এই নজরদারি চালানো যায় না কর্মীর অভাবে। গার্ডেনরিচে বেআইনি নির্মাণ ভেঙে ১৩ জনের মৃত্যুর পরে মেয়র ফিরহাদ হাকিম নির্দেশ দেন, বিল্ডিং বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের এলাকায় ঘুরে ঘুরে বেআইনি নির্মাণ চিহ্নিত করতে হবে। সেই কাজ হচ্ছে।
তবে কোনও ছাদে ব্যবসা চলছে কি না, তা নিয়ে কোনও নজরদারি নেই। কোনও নির্মাণ বেআইনি হলে পুর–আইনের ৪০১ ধারায় স্টপ ওয়ার্কের নোটিস দেওয়া হয়। সেই নির্মাণ বেআইনি প্রমাণিত হলে ৪০০(৮) ধারা প্রয়োগ করে তা ভেঙে ফেলার আইনি সংস্থানও রয়েছে পুর–আইনে। তবে এই আইনের প্রয়োগও কার্যত নেই বলেই জানাচ্ছেন পুর–আধিকারিকরা। এরই সুযোগ নিয়ে শহর জুড়ে গড়ে উঠেছে একের পর এক রুফটপ ক্যাফে।
এ দিকে এ দিনই, আগামী দু’সপ্তাহের জন্য কলকাতার সব রুফটপ রেস্তোরাঁ ভাঙায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। রেস্তোরাঁগুলির তরফে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে ‘ন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’। সেই মামলায় মঙ্গলবার বিচারপতি গৌরাঙ্গ কান্তের সিঙ্গল বেঞ্চ রেস্তোরাঁ ভাঙার পুরসভার নির্দেশ স্থগিত করেছে। পাশাপাশি ওই সব রুফটপ ক্যাফে আগামী দু’সপ্তাহ ব্যবসা করতে পারবে না বলেও নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।
এ দিন হাইকোর্টে মামলাকারীদের তরফে আইনজীবী জয়দীপ করের যুক্তি, যাবতীয় অনুমতি নিয়েই রুফটপ রেস্তোরাঁ, ক্যাফে শহরে চলছে। অথচ হঠাৎ করে কয়েকটি রেস্তোরাঁকে ভাঙার নোটিস দেওয়া হলো। কোনও শুনানি না করে, বক্তব্য না শুনেই ভাঙার কাজ শুরু করেছে পুরসভা।
এ ভাবে একতরফা কোনও পদক্ষেপ করা যায় না। যদিও পুরসভার আইনজীবীর যুক্তি, আইনে জরুরি পদক্ষেপের সংস্থান আছে। শুনানি শেষে হাইকোর্ট জানিয়ে দেয়, জরুরি ভিত্তিতে হলেও যেহেতু রেস্তোরাঁগুলির যাবতীয় অনুমোদন রয়েছে, তাই তাদের বক্তব্য না শুনে, নির্দিষ্ট সময় না দিয়ে সেগুলি এ ভাবে ভাঙা যাবে না। মামলাকারী সংগঠনের তরফে আর এক আইনজীবী মেঘলা দাস জানান, ৮০টির বেশি রুফটপ রেস্তোরাঁকে পুরসভা চিহ্নিত করলেও বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটিকে ভাঙার কাজ শুরু হয়। আপাতত সেই কাজ বন্ধ রাখতে হবে।