প্রথম স্থানাধিকারের আদর্শ স্বামীজি, রূপায়ণের একাগ্রতার শক্তি স্বামী বিবেকানন্দ
বর্তমান | ০৮ মে ২০২৫
সুখেন্দু পাল, বর্ধমান: মন যত বেশি একাগ্র হয়, একটি বিন্দু ততবেশি শক্তি বহন করতে সক্ষম হয়! এটাই রহস্য।—স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ আঁকড়ে কি সেই রহস্যের অনুসন্ধান করেছিলেন উচ্চ মাধ্যমিকের সেরাদের সেরা রূপায়ণ পাল? তা না হলে মাধ্যমিকের পঞ্চম স্থান থেকে এক লাফে উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম হওয়া খুব একটা সহজ ছিল না! আর সেই সহজ করার শক্তি জুগিয়েছেন যুগবতার স্বামীজি। তাঁর কাছ থেকেই রূপায়ণ নিয়েছেন একাগ্রতা ও নিষ্ঠার পাঠ। আবার স্বামীজির আদর্শে জাতীয়তাবোধেরও শিক্ষাও গ্রহণ করেছেন। তাই হয়তো নিজের রেজাল্ট সম্পর্কে নিস্পৃহ থেকে বেশি কৌতূহলী ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন সিঁদুর’ অভিযান নিয়ে। মেধা তালিকায় প্রথম হওয়ার আনন্দের আগেও রূপায়ণ ঠাঁই দিয়েছেন ভারতের বদলার সাফল্যের আনন্দকে।
রূপায়ণের পড়ার ঘরের আলমারিতে সাজানো বিবেকানন্দ, সারদাদেবীর বই। রয়েছে গল্প-উপন্যাসও। তবে, সবার সামনে বিবেকানন্দ। ছেলেবেলা থেকেই স্বামীজির অন্ধ ভক্ত। তাঁর আদর্শের অনুসারী। দিনের শুরু থেকে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত বিলে তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। নিয়ম, নিষ্ঠা ও একগ্রতায় বেঁধে রাখা ছন্দের জীবন। ছন্দের মূলমন্ত্র স্বামীজির বাণী। বুধবার গর্বের সঙ্গে রূপায়ণ তাই বলছিলেন, ‘স্বামীজিই আমাকে সফলতার পথ দেখিয়েছেন। তাঁর শিক্ষকরাও বলছেন, ‘এমন নিয়মানুবর্তিতা খুব কম ছাত্রের মধ্যেই দেখা যায়।’ যেমন, শিক্ষক দিলীপ বিশ্বাসের কথায়, ‘ওঁরা কিছুদিনের জন্য কাশ্মীর ঘুরতে গিয়েছিলেন। ট্রেনে যাওয়ার সময়ও রূপায়ণ অনলাইনে ক্লাস করেছে। এমনটা কোনও ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সচারাচর দেখা যায় না।’ রূপায়ণের প্রাপ্ত নম্বর বাংলায় ৯৮, ইংরেজিতে ৯৭, বায়ো সায়েন্সে ৯৯, কেমেস্ট্রি, ফিজিক্স এবং অঙ্কে একশোর একশো।
বর্ধমানের সুভাষপল্লিতে বাড়ি রূপায়ণের। বাবা রবীন্দ্রনাথ পাল হাইস্কুলের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। মা জয়শ্রী পালও ভাটাকুল স্বর্ণময়ী হাইস্কুলের ইংরেজির শিক্ষিকা। ছেলের সাফল্যে স্বাভাবিকভাবে গর্বিত তাঁরা। বলছিলেন, ‘ছেলেকে পড়াশোনার জন্য কোনও দিনই বলতে হয়নি। দিনে ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা পড়াশোনা করত। অবসর সময় গল্পের বই নিয়ে থাকত। মাঝে মধ্যে মোবাইল হাতে গেমও খেলত।’ রূপায়ণ বলছিলেন, ‘মাধ্যমিকের পর থেকেই ডাক্তারি পড়ার প্রস্তুতি নিয়েছি। একাগ্রতা, নিষ্ঠা আর পড়াশোনার প্রতি ভালোবাসা থাকলেই ভালো ফল যায়। মোবাইল থেকে সব সময় দূরে থাকতে হবে, এমনটা আমি মনে করি না। আমি নিজেও দিনের কিছু সময় গেম খেলতাম। তবে, সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু কনটেইন্ট থেকে পড়ুয়াদের দূরে থাকাই ভালো।
বর্ধমানের সিএমএস হাইস্কুলের ছাত্র রূপায়ণ। প্রধান শিক্ষক মিন্টু রায় বলছিলেন, ‘ওর নিয়মানুবর্তিতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। প্রথম থেকেই স্কুলে নজর কেড়েছিল। ও যে ভালো রেজাল্ট করবে সেটা আমাদের প্রত্যাশিত।’ এদিন রূপায়ণকে শুভেচ্ছা জানাতে বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন বর্ধমানের দক্ষিণের বিধায়ক খোকন দাস। তিনি বলেন, ‘মাধ্যমিক পরীক্ষার পরও ওঁর বাড়িতে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলাম। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরও আসার সুযোগ পেলাম। রূপায়ণ আমাদের জেলার গর্ব।’ জেলাপ্রশাসনের তরফেও রূপায়ণকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। জেলাশাসক আয়েশা রানি এ বলেন,
‘আগামীদিনেও রূপায়ণ সাফল্যের ধারা বজায় রাখবে বলে আমি আশাবাদী।’ মহকুমাশাসক তীর্থঙ্কর বিশ্বাস বলেন, ‘শুভেচ্ছা জানাতে বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওঁর এই সাফল্য দেখে অন্যরাও উৎসাহ পাবে।’
স্বামীজির চ্যালা রূপায়ণের কাছে বুধবার সকালটা ছিল বেশ অন্যরকম। কাকতালীয়ভাবে হলেও গভীররাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘সিঁদুর অভিযান’-এ অভূতপূর্ব সাফল্য আসে। ভোর হতে না হতেই টিভির পর্দায় পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটির ধ্বংসস্তূপ। বেলায় উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ। মেধা তালিকার একেবারে উপরে রূপায়ণ। স্বামীজির স্বদেশমন্ত্র স্মরণ করিয়ে দিয়ে রূপায়ণ বলছিলেন, ‘আজকের দিনটা আমার কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কুর্নিশ। দেখবেন, সব সাফল্য কিন্তু আসে একাগ্রতা ও নিয়মানুবর্তিতা থেকেই। সে পড়াশোনা হোক কিংবা এয়ার স্ট্রাইক।’ -নিজস্ব চিত্র