• আর কেউ যেন সিঁথির সিঁদুর না-হারান, আর্তি স্ত্রী জয়ার
    এই সময় | ০৮ মে ২০২৫
  • সঞ্চিতা মুখোপাধ্যায়, পুরুলিয়া

    ভোররাতেই তাঁর কাছে খবরটা এসে পৌঁছেছিল। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ঢুকে ভারতীয় সেনা ধ্বংস করে দিয়েছে সন্ত্রসবাদীদের ঘাঁটি। সফল ‘অপারেশন সিঁদুর।’

    এমনই একটা খবরের প্রতীক্ষাতেই যেন তিনি ছিলেন। ঝালদার বাঘমুন্ডি রোডের বাড়িতর আবহ নিমেষে পাল্টে গেল। স্বামীকে চিরকালের জন্য হারানোর যন্ত্রণা তো কখনও মুছবে না, কিন্তু গত মাসে পহেলগামে চোখের সামনে সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে স্বামীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সেই মর্মস্পর্শী ক্ষতে হয়তো বা খানিকটা প্রলেপ পড়ল!

    কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিক মণীশরঞ্জন মিশ্রের স্ত্রী জয়া বলে ওঠেন, ‘এ ভাবেই সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদীদের নির্মূল করে দিতে হবে। যেন আর কখনও কোনও মহিলার সিঁথির সিঁদুর ওরা মুছে দিতে না–পারে।’ পরিবার সূত্রের খবর, ম​ঙ্গলবার মাঝরাতে ভারতীয় সেনার প্রত্যাঘাতের খবর শোনার পরেই সন্তানদের বুকে আঁকড়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন মণীশের স্ত্রী। ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

    ২২ এপ্রিল ২০২৫। পহেলগামে নিরীহ পর্যটকদের উপরে সন্ত্রাসবাদীদের নির্বিচারে গুলি চালানোর ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন মণীশও। স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়ের সামনেই গুলি করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই দৃশ্য এখনও তাড়া করে চলেছে গোটা পরিবারকে।

    পরিবারের বিশেষ বন্ধু মুকেশ ভগত বলছিলেন, ‘ভোররাতে মোবাইলে প্রথম খবরটা পাই। পরে আত্মীয়–স্বজনরাও ফোন করে ‘অপারেশন সিঁদুরে’র খবর দেন। সেই খবর শোনার পরেই উনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। জঙ্গিদের যে কোনও মূল্যে শেষ করে দেওয়ার কথা বলতে থাকেন। শরীর এবং মনের দিক থেকে উনি এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারেননি। ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এখন ঠিক আছেন।’

    প্রয়াত মণীশের ছেলে সমৃদ্ধ রীতিমতো উত্তেজিত এই খবরে। পরিবার সূত্রের খবর, অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া প্রতিজ্ঞা করেছে, বাবার মতো সে–ও ভবিষ্যতে সন্ত্রাসবাদকে নিকেশ করবে। মোবাইলে ‘অপারেশন সিঁদুরে’র খবর দেখার পরে সে বলতে থাকে, ‘ওই সময়ে বাবার পাশেই ছিলাম। সন্ত্রাসবাদীরা যে পুরো জায়গা ঘিরে ফেলেছে, বাবা তা বুঝতে পেরেছিল। শেষ মুহূর্তেও আমাদের মাটিতে শুয়ে পড়তে বলেছিলেন। সেই সময়েই পিছন থেকে একটি গুলি বাবার শরীরে এসে লাগে।’

    একটু দম নিয়ে সমৃদ্ধ ফের বলতে শুরু করে, ‘বাবা স্বপ্ন দেখত, আমি যেন আইএএস অফিসার হই। আমি সেই স্বপ্ন পূরণ করবই। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এই লড়াই জারি থাকবেই। জঙ্গিমুক্ত পৃথিবী দেখতে চাই।’

    ঘটনাচক্রে এ দিনই ছিল মণীশের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। ঝালদায় মিশ্রবাড়িতে হাজির হয়েছিলেন আত্মীয়পরিজনদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও। বাড়ির বাইরের ঘরে রাখা হয়েছিল মণীশের একটি ছবি। সেখানে মাল্যদান করে প্রত্যেকে জানিয়েছেন, এখানেই থেমে থাকলে চলবে না। যত সময় লাগুক না–কেন, জঙ্গিদের সমূলে শেষ করতেই হবে। ভারতীয় সেনার প্রতি সকলের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।

    মণীশের ভাই রাহুলরঞ্জনের চোখে জল। তিনি বলছিলেন, ‘এই খবর নিঃসন্দেহে আমাদের কাছে ভালো, তবে এ–ও বলতে চাই, আর কোনও পরিবারকে যেন এমন পরিস্থিতির মুখে না–পড়তে হয়।’

    মণীশের আর এক ভাই বিনীতরঞ্জনের প্রতিক্রিয়া, ‘আমি মনে করি শুধু পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীরাই নয়, পহেলগামেও ওদের কোনও চর ছিল, যে বা যারা এই খবর দিয়েছিল। দেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সেই বিশ্বাসঘাতকদেরও কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে। এটা অনেক বড় মাপের লড়াই। একটা এয়ার স্ট্রাইকেই তা শেষ হবে না।’

  • Link to this news (এই সময়)