• সে দিন কলকাতায় বেজে ওঠে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি...’
    এই সময় | ০৮ মে ২০২৫
  • সুনন্দ ঘোষ

    কলকাতা ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উড়ে যাওয়ার পরেই সে দিন নোটাম নিয়েছিল কলকাতা এয়ারপোর্ট। ১৯৭১–এর ৩ ডিসেম্বর। নোটাম মানে নোটিস টু এয়ারমেন। তার মাধ্যমেই বিশ্বকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আপাতত যে কোনও কমার্শিয়াল ফ্লাইটের জন্য বন্ধ থাকছে কলকাতা বিমানবন্দর।

    বাংলাদেশের সঙ্গে যে যুদ্ধ ৭১–এ শুরু হয়েছিল, তার দামামা অনেক আগেই বেজে গিয়েছিল। অমলেন্দু জানাচ্ছেন, ১৯৬৫–তেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, এখনকার বাংলাদেশ তাদের আকাশ বন্ধ করে দিয়েছিল ভারতীয় এয়ারলাইন্সের জন্য। ঠিক যেমন এখন পাকিস্তানের আকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

    অমলেন্দুর কথায়, ‘তখন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স ছাড়াও কলকাতা থেকে জ্যাম এয়ার বলে একটা কার্গো ফ্লাইট চলত। এয়ারওয়েজ ইন্ডিয়া নামেও একটা এয়ারলাইন্স ছিল। সবই ছোট ছোট বিমান। কলকাতা থেকে উত্তর–পূর্বের যে কোনও রাজ্যে যেতে হলেই আমাদের বাংলাদেশের আকাশ টপকে যেতে হয়। এখনও তাই। তখন ৬৫–তে সেই আকাশ বন্ধ করে দেওয়ায় কলকাতা থেকে সটান উত্তরে গিয়ে বাগডোগরা ঘুরে উত্তর–পূর্বের রাজ্যে যেতে হচ্ছিল। তখন ডিব্রুগড়, লীলাবাড়িতে নিয়মিত ফ্লাইট ছিল। ডাকোটা ছিল, ডর্নিয়ার ছিল।’

    ১৯৭১–এর ডিসেম্বরে যুদ্ধ ঘোষণার আগেই পাকিস্তানের ফাইটার জেটের মেশিনগান থেকে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলা হয় আগরতলার এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)–র এক অফিসারকে। তারপরে শুরু হলো যুদ্ধ।

    ৫৪ বছর আগের স্মৃতির ডালি খুলে বসেন অমলেন্দু, — ‘আমাকে আর আমার তখনকার বস মিস্টার হাজরাকে রেগুলার ফোর্ট উইলিয়ামে যেতে হতো ব্রিফিংয়ের জন্য। সেখানে আমাদের সঙ্গে আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স কো–অর্ডিনেশন মিটিং করত। সেই মিটিংয়ে কাগজ–কলম ব্যবহার করে কোনও নোট নেওয়ার পারমিশন ছিল না। যা আলোচনা হতো, তা শুধু মাথার ভিতরে স্টোর করতে হতো। আর একটা বিষয় দেখে অবাক হতাম।

    ফোর্ট উইলিয়ামের বিশাল হলে, বিরাট এক টেবিলের উপরে বিশালাকার এক ম্যাপ খুলে আলোচনা হতো। সেটা বাংলাদেশের ম্যাপ। সমস্ত খুঁটিনাটি সেই ম্যাপে থাকত। নদী–নালা, খাল–বিল সব থাকত ম্যাপে। সেই ম্যাপ খুলে খুলে আক্রমণের নকশা তৈরি হতো।’

    যুদ্ধের সময়ে কলকাতা ও উত্তর–পূর্ব ভারতের সিভিল এয়ারপোর্ট ব্যবহারের নিরিখে চিফ কো–অর্ডিনেটিং অফিসার ছিলেন মিস্টার বিনয় হাজরা। আর্মি তাঁর সঙ্গেই যোগাযোগ করত।

    অমলেন্দু বলেন, ‘৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরুর পরে একটানা ৪৮ ঘণ্টা আমরা এয়ারপোর্টে বসে ছিলাম। এটিসি–তে আর্মি অফিসারের পোস্টিং হয়েছিল। ব্ল্যাক আউটের নির্দেশ এসেছিল দিল্লি থেকে। শুধু এয়ারপোর্ট নয়, সন্ধের পরে মাঝেমধ্যেই গোটা রাজ্য কার্যত অন্ধকারে ডুবে থাকত। পাকিস্তানি যুদ্ধ–বিমান ঢুকে আসত আমাদের আকাশে। বিমানকে গুলি করে নামিয়ে আনার এত আধুনিক ব্যবস্থা তখন ছিল না। মানুষকে সতর্ক করতে ঘন ঘন সাইরেন বাজত। আর টুপটাপ করে আলো নিভে যেত। খবর পেয়ে বিভিন্ন বেস থেকে আকাশে উড়ত আমাদের যুদ্ধ–বিমান। আকাশে মুখোমুখি লড়াই হতো পাকিস্তান ও ভারতীয় যুদ্ধ–বিমানের। আমরা বলতাম ডগ–ফাইট। কখনও কলকাতার, কখনও খড়্গপুরের আকাশে সেই ডগ–ফাইট হতো। তখন কন্ট্রোল টাওয়ারের রেডারও এত ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল না। ফলে লো–ফ্লাই করা বিমানের গতিবিধি রেডারে ধরা পড়ত না।’

    প্রথম কয়েকদিন কলকাতা এয়ারপোর্ট পুরোপুরি বন্ধ থাকলেও পরে তা খুলে দেওয়া হয়। সেই সময়ে কলকাতার রেড রোড–কেও এয়ারস্ট্রিপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে ছোট ছোট যুদ্ধ–বিমান ওঠানামা করত। এ ছাড়াও কলাইকুন্ডা, পানাগড়, পুরুলিয়ার ছররা, বাগডোগরা, বালুরঘাটের এয়ারস্ট্রিপও ব্যবহার করা হয়।

    ১৯৬২–তে এরোড্রোম অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন অমলেন্দু। সে বছরেই চিনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধে। তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় পানাগড়ে। সে দিনের অনেক কথা আজ আর বিস্তারিত মনে নেই ৮৭–র বৃদ্ধ। চারটে স্টেন্টের পরে বুকে পেসমেকারও জায়গা করে নিয়েছে। এখনও সুঠাম দেহ। স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন বৃদ্ধাবাসে।

    যুদ্ধ তখন সবে শেষ হয়েছে। কলকাতায় নামার কথা শেখ মুজিবের। স্মৃতি হাতড়ে অমলেন্দু বললেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী উপস্থিত বিমানবন্দরে। সঙ্গে অগনিত মানুষ। ঠিক ছিল, রাওয়ালপিন্ডি থেকে কলকাতায় নেমে ইন্দিরার সঙ্গে দেখা করে ঢাকায় যাবেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু, কোনও কারণে সে দিন মুজিবের বিমান কলকাতায় নামল না। সরাসরি ঢাকায় উড়ে গেল।

    সে কী অশান্তি! উন্মত্ত জনতা এয়ারপোর্টের কাচের দেওয়াল ভেঙে তছনছ করে দিল। তার কয়েকদিন পরে আবার মুজিব আসবেন বলে আমরা জানতে পারলাম। আবার প্রধানমন্ত্রী হাজির কলকাতায়। এ বার উন্মত্ত জনতাকে আটকাতে একেবারে নাগেরবাজার থেকে ব্যারিকেড করা হলো।

    বিরাটির দিক দিয়ে মুজিবের বিমান নামার সময়ে সামনে ঘন মেঘ চলে এলো। ফ্লাইট গেল ঘুরে। আমরা আবার প্রমাদ গুনলাম। তারপরে পাইলটকে বলা হলো উল্টোদিক দিয়ে নামতে। এ বার নেমে এলো বিমান। বিমান থেকে নামলেন মুজিব। হাসিমুখে স্বাগত জানালেন ইন্দিরা গান্ধী।’

    সে দিন কলকাতায় বেজে উঠেছিল, ‘আমার সোনার বাংলা। আমি তোমায় ভালোবাসি।’ চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছিল অমলেন্দুর।

  • Link to this news (এই সময়)