• ভাইঝির বিয়ের ঘটকালি করতে এসে পা রেখেছিলেন কবি, ১৫০ বছরের স্মৃতি আঁকড়ে কৃষ্ণনগরের ‘রানিকুঠি’
    বর্তমান | ০৯ মে ২০২৫
  • অগ্নিভ ভৌমিক, কৃষ্ণনগর: মৃৎশিল্পের শহর কৃষ্ণনগরের সঙ্গে নিবিড় যোগ রয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। প্রায় ১৫০বছর আগে ভাইঝির বিয়ের ঘটকালি করতেই প্রথম কৃষ্ণনগরে পা রেখেছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল ভাইঝি প্রতিভাসুন্দরী দেবী ও আশুতোষ চৌধুরীর পরিণয় সুসম্পন্ন করা। কৃষ্ণনগরের সঙ্গে রবি ঠাকুরের সম্পর্ক এইভাবেই গড়ে ওঠে। তারপরই ভালোবেসে ফেলেছিলেন মৃৎশিল্পের এই শহরকে। লিখেছিলেন একের পর এক কালজয়ী কবিতা-গল্প। কৃষ্ণনগর শহরের উপর দিয়ে বয়ে চলা অঞ্জনা নদীর কথা পাওয়া গিয়েছে রবি ঠাকুরের কবিতায়। এই কৃষ্ণনগর থেকেই লিখেছিলেন জনপ্রিয় ছোটগল্প ‘পণরক্ষা’। আর সেই সমস্ত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে কৃষ্ণনগরের ‘রানিকুঠি’। রবি ঠাকুরের স্মৃতি আঁকড়ে থাকা সেই রানিকুঠি বর্তমানে ভগ্নদশায়।

    ১৮৮৬ সালের এপ্রিল মাসে মাত্র ২৫বছর বয়সে কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন রবি ঠাকুর। সঙ্গে ছিলেন ভাগ্নে সত্যব্রত গঙ্গোপাধ্যায় এবং দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা রমণীমোহন চট্টোপাধ্যায়। কৃষ্ণনগরের চৌধুরী পরিবারের অতিথি হিসেবে তাঁরা রাত কাটিয়েছিলেন ঐতিহাসিক রানিকুঠিতে। রবি ঠাকুরের সেই ‘কৃষ্ণনগর অভিযান’ ব্যর্থ হয়নি। সেই বছরই আশুতোষ ও প্রতিভার শুভ বিবাহ সুসম্পন্ন হয়েছিল। যদিও অনেকেই মনে করেন, এই বিয়ে শুধুমাত্র একটি পারিবারিক ঘটনা ছিল না। বরং এক তরুণ কবির সাংসারিক যোগাযোগের সাক্ষ্য ছিল। বিয়ে তখন সমাজে এক বৃহৎ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। আর ঠাকুর পরিবার এই পরম্পরায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এমনকী, এই ঘটনার মধ্যে দিয়েই আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হয়। যা পরে তাঁদের পরিবারের কর্মক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ পাঁচ বছর আগে বিলেত যাত্রায় সহযাত্রী বনেদি পরিবারের সন্তান আশুতোষের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে চেয়েছিলেন রবি ঠাকুরও।

    শুধু রানিকুঠি নয়, সেই সময় রতনতনু লাহিড়ীর ভাইপো সত্য লাহিড়ীর ডিসপেন্সারিতে গান-বাজনার আসর বসেছিল। ‘বাঁশি বাজাতে চাই...’ গেয়ে রবীন্দ্রনাথকে মার্গসঙ্গীত সমঝদার শ্রোতাদের বিদ্রুপের মুখেও পড়তে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণনগর ভ্রমণের এই বিশেষ উপলক্ষ্যই পরবর্তীতে শহরের সঙ্গে তাঁর সাহিত্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। শহরের বুক চিরে প্রবাহিত অঞ্জনা নদীকে তিনি তাঁর কবিতায় স্থান দেন। ‘পণরক্ষা’-র মতো গল্প রচনার পিছনেও কৃষ্ণনগরের প্রভাব অনস্বীকার্য। সবুজ পত্রিকার সম্পাদক লেখক প্রমথ চৌধুরী তাঁর আত্মকথায় লিখেছিলেন, ‘আমি আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের প্রথম দর্শন লাভ করি। দাদা আশুতোষ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এক জাহাজে বিলেতযাত্রা করেছিলেন‌। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মাদ্রাজ থেকে ফিরে আসেন। এই অল্প সময়ের মধ্যেই দাদার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব হয়।‌ তাই রবীন্দ্রনাথ দাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন।...রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে সংক্ষেপে আমার বক্তব্য এই যে, আমি প্রথমেই আবিষ্কার করি, তিনি দেহ ও মনে একটি লোকোত্তর পুরুষ।’

    শোনা যায়, কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলে একবার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার সিট পড়েছিল রবীন্দ্রনাথের। সেই সময় তাঁর আসার সুযোগ ছিল। কিন্তু স্ত্রী ও কন্যার শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি আসতে পারেননি। শহরের প্রবীণ বাসিন্দা সঞ্জীব দত্ত বলেন, ঐতিহ্যশালী কৃষ্ণনগর ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। রবি ঠাকুরের অনেক সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্র হল কৃষ্ণনগর। ভাইঝির জন্য ঘটকালি করতেই তিনি প্রথম এই শহরে এসেছিলেন।
  • Link to this news (বর্তমান)