যুদ্ধ সব বদলে দেবে না তো! নিরাপত্তা মহড়ায় প্রশ্ন পড়ুয়াদের
আনন্দবাজার | ০৯ মে ২০২৫
কাশ্মীরে পর্যটকদের উপরে হামলার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধ লাগলে কী করতে হবে, আকাশপথে হামলা হলেই বা কী করণীয়, এ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই আলোচনা চলছে নানা মহলে। দেশের নানা প্রান্তে নিরাপত্তা মহড়া চালানো হতে পারে বলেও খবর। এই পরিস্থিতিতে স্কুল কর্তৃপক্ষের তরফে বুধবার নিরাপত্তা মহড়া চালানো হল শহরের চারটি স্কুলে। পড়ুয়াদের কী পরিস্থিতিতে, কোথায় লুকোতে হবে, আগুন লেগে গেলেই বা কী করণীয়, দেখানো হল সবই। প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত পাঠ দিলেন উপস্থিত চিকিৎসকেরা। যদিও সমস্ত স্কুল কর্তৃপক্ষেরই দাবি, এই পরিস্থিতিতে সমস্ত পড়ুয়াই জানে, কেন মহড়া হচ্ছে। ভয় না পেয়ে আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য যাতে পড়ুয়ারা প্রস্তুত থাকতে পারে, সেই কারণেই এই উদ্যোগ। যদিও পড়ুয়াদের অনেকে বলছে, ‘‘যুদ্ধ হলে তো আশপাশের সমস্ত কিছুই বদলে যাবে। সন্ত্রাসবাদ শেষ হোক, কিন্তু যুদ্ধ চাই না।’’
সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ প্রথম নিরাপত্তা মহড়া হয় রিজেন্ট পার্কের দ্য ফিউচার ফাউন্ডেশন স্কুলে। তত ক্ষণে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে ভারতের হানার খবর ছড়িয়ে পড়েছে। পড়ুয়াদের মধ্যেও তা নিয়ে প্রবল উৎসাহ দেখা গেল। কারা মোবাইল ফোনে কী রকম ভিডিয়ো দেখেছে, সেই বর্ণনা দিচ্ছিল তারা। এর মধ্যেই স্কুলের ঘণ্টা বেজে উঠল। তার কিছু ক্ষণ আগেই শিক্ষিকারা বুঝিয়ে গিয়েছেন, সাইরেন বাজলেই যে যেখানে থাকুক, মাথা বাঁচাতে মাটিতে বসে পড়তে হবে। সম্ভব হলে, কোনও আচ্ছাদনের নীচে নিজেকে নিয়ে যেতে হবে। সহজ সমাধান হিসাবে স্কুলের বেঞ্চ, টেবিলের নীচে আশ্রয় নিতে বলা হয়। সেই মতোই পড়ুয়ারা বেল বাজতেই কেউ বেঞ্চের নীচে, কেউ বারান্দায় আচ্ছাদনের নীচে বসে পড়ে। কানে হাত গুঁজে বসে থাকতে দেখা যায় তাদের। প্রধান শিক্ষিকা সুচন্দ্রা লাহা বললেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বাচ্চাদের বোঝানো হয়েছে। এই মুহূর্তে আত্মরক্ষার পাঠ সব চেয়ে জরুরি।’’
একই রকম মহড়া হয় মিন্টো পার্কের লা মার্টিনিয়ার ফর বয়েজ় এবং লা মার্টিনিয়ার ফর গার্লস স্কুলে। বেলা ১১টা ২০ মিনিটে স্কুলের ঘণ্টা বাজতেই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নির্দেশমতো ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা স্কুলের বেঞ্চের নীচে বসে পড়ে। কারও কানে হাত, কেউ ঢেকে রেখেছিল নিজের চোখ-মুখ। এই ভাবে মিনিট দশেক কাটানোর পরে শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মীদের নির্দেশে স্কুলের মাঠে গিয়ে জড়ো হয় পড়ুয়ারা। সেখানে প্রথমে অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্র হাতে নিয়ে দেখানো হয়, আগুন লাগার আপৎকালীন পরিস্থিতিতে কী করণীয়। এর পরে উপস্থিত চিকিৎসক সন্দীপ সরকার দেখান, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কী ভাবে একে অন্যের পাশে দাঁড়ানো যায়। সেখানেই পুরনো স্কুল ভবনের নীচে কয়েকটি কুঠুরি দেখিয়ে এক পড়ুয়া শিক্ষিকাকে বলে, ‘‘এইগুলোর মধ্যে ঢুকে থাকলেই তো মাথা বাঁচানোর আর চিন্তা করতে হয় না!’’
বিষয়টি ভেবে দেখা হবে জানিয়ে শিক্ষিকারা এর পরে পড়ুয়াদের ফিরিয়ে নিয়ে যান ক্লাসে। বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ একই ভাবে গার্লস স্কুলের ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও অগ্নি-নির্বাপণ যন্ত্রের ব্যবহার দেখানোর পাশাপাশি স্কুলের ক্লাসে ফিরিয়ে নিয়ে এসে বেঞ্চের নীচে কী ভাবে বসে পড়তে হবে, তা দেখানো হয়। এই সময়েই এক পড়ুয়াকে বলতে শোনা যায়, ‘‘বেঞ্চের নীচে কি আদৌ মাথা বাঁচবে। তার চেয়ে যুদ্ধটাই বন্ধ করলে হয় না!’’ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রূপকথা সরকার বললেন, ‘‘যুদ্ধ কাম্য নয়। কিন্তু আমাদের প্রস্তুত থাকতেই হবে।’’
ডিপিএস রুবি পার্কে আবার অষ্টম এবং নবম শ্রেণির এনসিসি-র পড়ুয়ারা এ দিনের মহড়ায় যোগ দেয়। স্কুলের কনফারেন্স রুমে এনে হাতেকলমে দেখানো হয় সাইরেন বাজলে কী করতে হবে। মোবাইলে বাজানো হয় সাইরেন। এই স্কুলেরই অন্যান্য শ্রেণির পড়ুয়াদের সমস্ত বিষয়টি বোঝানো হয় ‘পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজ়েন্টেশন’-এর মাধ্যমে। দ্বাদশ শ্রেণির কয়েক জন পড়ুয়া জানায়, হঠাৎ আকাশপথে শত্রু আক্রমণ করলে কী করতে হবে, তা তারা ভিডিয়োর মাধ্যমে জেনেছে। তাদের বলা হয়, ঘরের সমস্ত আলো বন্ধ করে দিতে হবে। দরজা-জানলা বন্ধ করে দিতে হবে। এমনকি, পর্দাও টেনে দিতে হবে বলে জানানো হয়। এক পড়ুয়ার মন্তব্য, ‘‘ভয়ে রয়েছি, যুদ্ধে চেনা সব কিছু বদলে যাবে না তো? সন্ত্রাসবাদ শেষ হওয়া দরকার। তবে যুদ্ধ চাই না।’’ স্কুলের প্রিন্সিপাল জয়তী চৌধুরী বলেন, ‘‘পড়ুয়ারা সকলেই যোগ দিয়েছে। পরিস্থিতি যা-ই হোক, আমাদের পড়ুয়ারা তৈরি।’’