কলকাতার কলোনিতে ফিরে এল সাইরেনের স্মৃতি। নিয়ম করে প্রতিদিন ঠিক সকাল ন’টায় বেজে উঠত সেই সাইরেন। যা শুনে শুরু হতো স্কুল ও অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি। দোকানিরা মিলিয়ে নিতেন হাতঘড়ি।
স্মৃতি হাতড়ে দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুর–টালিগঞ্জ এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানালেন, আটের দশকের শেষে ধীরে ধীরে বন্ধ হয় সেই সাইরেন বাজা। প্রায় চার দশক পরে মক ড্রিলের অনুষঙ্গে সাইরেন বাজবে শুনে ফিরেছিল সেই স্মৃতি। যদিও মক ড্রিল হলেও যাদবপুর-টালিগঞ্জের কেউ বুধবার সাইরেন শুনতে পাননি।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি টিন–এজারদের কাছে সুপারহিট হয়েছিল নচিকেতা চক্রবর্তীর ‘সে প্রথম প্রেম আমার নীলাঞ্জনা’ গানটি। সেই গানের কলি ছিল, ‘লাল ফিতে সাদা মোজা সু-স্কুল ইউনিফর্ম/ ন’টার সাইরেন সংকেত; সিলেবাসে মনোযোগ কম...’।
সে দিনের টিন–এজার যাদবপুরের বাঘাযতীন কলোনির বাসিন্দা শ্যামলী সাহা এখন মাঝবয়সি। তাঁর কথায়, ‘সাইরেন শোনা মানেই বই বন্ধ করে স্নানের জন্যে ছুটতাম। স্কুল যাওয়ার প্রস্তুতি। সব বন্ধুরই ছিল একই রুটিন।’
টালিগঞ্জের গান্ধী কলোনি বয়েজ স্কুলের ছাদে এখনও রয়েছে সেই সাইরেন। এক সময়ে সবুজ রঙের সাইরেনটা এখন তামাটে। স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক অশ্বিনীনগর কলোনির বাসিন্দা তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘প্রতিদিন বাজত সাইরেনটা। নিয়ম করে পুলিশ এসে দেখে যেত সাইরেন ঠিক আছে কি না।’ স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক আশিসকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে আমরা সাইরেনটা সংরক্ষণ করতে চাই।’
এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা গান্ধী কলোনি বয়েজ স্কুলের প্রাক্তনী শিবপ্রসাদ ঘোষ দস্তিদার জানান, ষাটের দশকে ভারত–চিন যুদ্ধের সময়ে এই সাইরেন লাগানো হয়। পরে ভারত–পাক যুদ্ধের সময়েও সাইরেন বাজত।
বিজয়গড় মাঠ, বাঁশদ্রোণীর অনেক জায়গায় বাঙ্কারের মতো গর্ত খুঁড়ে দিয়েছিল মিলিটারি। যাতে সাইরেন বেজে উঠলেই সাধারণ মানুষ ওই গর্তে গিয়ে আশ্রয় নেন। শত্রুপক্ষের বোমা থেকে জনসাধারণকে বাঁচাতে এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাঁর কথায়, ‘আমি সাইরেনের শব্দ শুনেই অফিস বেরোনোর প্রস্তুতি শুরু করতাম।’
টালিগঞ্জ, যাদবপুরের উষা, কৃষ্ণা গ্লাসের মতো কারখানায় ডিউটি শিফটিংয়ের সময়েও সাইরেন বাজত। সে সব কারখানারই সাইরেন। প্রবীণ ক্রীড়া সাংবাদিক চিরঞ্জীব জানান, তিনি এক সময়ে কসবায় থাকতেন। উষা কোম্পানির সাইরেনের শব্দ শুনেই স্কুল যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করতেন। তাঁর কথায়, ‘সেই সময়ে কলোনির অনেক বাড়িতেই ঘড়ি ছিল না। তাঁরা কারখানার সাইরেনের শব্দেই সময় বুঝে নিতেন।’
বেহালার পূর্ব পুটিয়ারির ব্যানার্জিপাড়ার বাসিন্দা প্রাক্তন ফুটবলার সুব্রত গুহ বলেন, ‘সকাল হলে পাড়ার মাঠে ফুটবল নিয়ে প্র্যাকটিসে যেতাম। সাইরেন বাজলে বাড়ি ফিরতাম স্কুলে যাওয়ার জন্যে।’
ওই পাড়ারই বাসিন্দা প্রাক্তন সেনাকর্মী বছর আশির শিবেন্দ্র বটব্যাল ষাটের দশকে ভারত–চিন, পরে ভারত–পাক যুদ্ধে লড়েছিলেন দেশের শত্রুদের বিরুদ্ধে। তাঁর কথায়, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের হামলার সম্ভাবনা তৈরি হলেই সেনাদের সতর্ক করতে সাইরেন বেজে উঠত। অবসরের পর আর সে শব্দ শুনিনি। তাই আবার সাইরেন বাজবে শুনে অন্তত এক বার সেই শব্দ শোনার জন্যে মুখিয়ে ছিলাম।’ যদিও সেই সাইরেন বাজল না।