মাস কয়েক আগে লঞ্চ করা হয়েছিল স্পেশাল এডিশনের ওই প্যাকেজিং। স্কচ–হুইস্কির একটি ব্র্যান্ডের স্পেশাল এডিশন। কেসের মধ্যে ভরা হুইস্কির বোতল। ওই বোতল–বাক্স বা কেসিংয়ে চোখ আটকাতে বাধ্য। কারণ? রবি ঠাকুর।
রবি ঠাকুরের গীতবিতানের ৫২ নম্বর কবিতা ‘খাঁচার পাখি ছিল সোনার খাঁচাটিতে, বনের পাখি ছিল বনে’ লাইন দু’টি বাঙালির কাছে বিশেষ পরিচিত। কিন্তু তা বলে মদের বোতলের কেসিংয়ে এমন লাইন! শুধু কি তা–ই! কেসিংয়ে আকর্ষক ক্যালিগ্রাফিতে লেখা রয়েছে ‘দুই পাখি’।
যদিও গীতবিতানে কবিতাটির কোনও নাম নেই। পঁচিশে বৈশাখ রাজ্য জুড়ে রবি ঠাকুরকে নিয়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠান এবং প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এ বছর আজ, শুক্রবারও হবে। সংগ্রাহকদের কাছে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত নানা ধরনের স্মারক সংগ্রহ খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু সুরার স্পেশাল এডিশনেও রবি ঠাকুর! এমন সংগ্রহ এ বছরের পঁচিশে বৈশাখের আগে অনেকেরই আগ্রহ বাড়াচ্ছে।
কী ভাবে হুইস্কির স্পেশাল এডিশনের প্যাকেজিংয়ে রবি ঠাকুরের কবিতার লাইন এল? কী ভাবেই বা সেই ক্যালিগ্রাফি তৈরিতে যুক্ত হলেন চন্দননগরের শিল্পী?
জবাবে সেই শিল্পী রূপক নিয়োগী ‘এই সময়’–কে বলেন, ‘ওই সুরা প্রস্তুতকারক সংস্থা প্রথমে দেশের ১২টি ভাষা নির্বাচন করে প্রতিটি ভাষার এক জন করে, মোট ১২ জন ক্যালিগ্রাফারকে দিল্লির একটি ওয়ার্কশপে ডাকে। আমি সেই দলে ছিলাম। সেখান থেকে ছ’জনকে শর্টলিস্ট করা হয়। হিন্দি, হরিয়ানভি, তেলুগু, তামিল এবং গুরুমুখীর পাশাপাশি বাংলাকেও ওঁরা বেছে নেন।’
শিল্পী বলেন, ‘তার পর আমাদের বলা হয় নিজের নিজের ভাষায় এমন কোনও সাহিত্যিকের লেখা বেছে নিতে, যাঁর কাজের সঙ্গে মানুষজন বিশেষ ভাবে পরিচিত। আমি রবি ঠাকুরকে বেছে নিই। ওঁর ওই কবিতার লাইনগুলোর ক্যালিগ্রাফি করি। কবিতার শিরোনামও স্পেশাল ইলাস্ট্রেশনে ‘দুই পাখি’ লিখি।’ রূপক নিয়োগী বলছেন, ‘ইলাস্ট্রেশনে আমি বরাবর সত্যজিৎ রায়ের ভক্ত।’ শেষ পর্যন্ত সুরার স্পেশাল প্যাকেজিংয়ের কেসে দেখা যায় রবি ঠাকুরের ওই কবিতার দু’টি লাইন এবং ‘দুই পাখি’ নাম।
সব কিছু ছেড়ে শেষ পর্যন্ত মদের বোতলের কেসিংয়েও রবি ঠাকুর! ব্যাপারটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? কোথাও কি ওঁকে একটু ‘ছাড় দেওয়া’ উচিত নয়? ‘আমি তো তা–ই মনে করি’, মন্তব্য বিশ্বভারতীর বাংলার বিভাগীয় প্রধান এবং বাংলাদেশ ভবনের ডিরেক্টর মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের।
তিনি বলেন, ‘সব কিছুতেই রবি ঠাকুরকে পণ্যে পরিণত করার কি দরকার আছে? মদের বোতলে রবি ঠাকুরের লাইন— ওঁকে কি একটু ‘তরল’ এবং ‘লঘু’ করে দেখায় না? ওঁকে দৈনন্দিন জীবনে যে ভাবে গ্রহণ করা উচিত ছিল, সেটা আমরা করতে পারিনি। কিন্তু বাণিজ্যিকীকরণ খুব ভালো ভাবেই করেছি। এটা দুঃখজনক।’
তবে একেবারেই ভিন্ন মত পোষণ করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক জয়দীপ ঘোষ। তিনি বলেন, ‘যে যুগে চিত্রতারকা এবং ক্রিকেটাররা সব চেয়ে জনপ্রিয়, সেই যুগে এবং রবি ঠাকুরের মৃত্যুর প্রায় সাড়ে ৮ দশক পরেও বিপণনের জন্য একটি সুরা প্রস্তুতকারক সংস্থা রবি ঠাকুরের কবিতার লাইন নির্বাচন করছে— এর চেয়ে চমকপ্রদ আর কী হতে পারে! উনি যে কত বড় আইকন, তা তো এখান থেকেই বোঝা যায়।’
জয়দীপের সংযোজন, ‘সুরার কেসিংয়ে ওঁর কবিতার লাইন থাকায় আমি ব্যক্তিগত ভাবে খারাপ কিছু দেখছি না। উনি সবার। সুরাপায়ীর রবীন্দ্রভক্ত হতে বাধা কোথায়?’