• ভাতার প্রভাবে অমিল মজুর, সঙ্কটে চাষ
    এই সময় | ০৯ মে ২০২৫
  • দিব্যেন্দু সরকার, আরামবাগ

    রেশন থেকে মিলছে বিনা পয়সার চাল। মাস শেষ হতে না হতেই ঢুকে যাচ্ছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের টাকা। বয়স্ক ভাতার টাকা পাচ্ছে মা–বাবা। ফলে সংসারে আর আগের মতো অভাব নেই। তাই দিন মজুররা অনেকেই চাষের কাজ করছেন না।

    জমিতে ধান রোয়া, ধান কাটা, ধান ঝা়ডার জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁরা অন্যের জমিতে চাষ করতেন তাঁদের ছেলে–মেয়েরাও আর নতুন করে এই পেশায় আসছে না। ফলে জমিতে চাষ করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে, আক্ষেপের সুর আরামবাগের বাসিন্দা অচিন্ত্য কুণ্ডুর গলায়।

    স্থানীয় একটি রাইস মিলের মালিক অচিন্ত্যর ব্যাখ্যা, একশো দিনের কাজের প্রকল্প আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার চালু হওয়ার পর থেকে জমিতে চাষ করার জন্য মজুর পাওয়া যাচ্ছে না। চাষের খরচ–খরচা বাড়লেও ঠিকমতো ফসলের দামও পাওয়া যাচ্ছে না। তাই চাষবাস ছেড়ে দিয়ে অনেকে জমি বিক্রি করে ব্যবসা করছেন। কেউ আবার ব্যাঙ্কে টাকা রেখে সুদের পয়সায় সংসার চালাচ্ছেন।

    তাঁর কথায়, ‘আগে আমাদের বাপ–কাকারা নিজেরাই চাষবাস করতেন। আর এখন আমাদের ছেলে–মেয়েরা জমির দিকে ঘুরেও তাকায় না। ফলে জমি রেখে কী করব? তার থেকে বরং প্রোমাটারের কাছে জমি বিক্রি করে দিলে মোটা টাকা পাওয়া যাবে।’

    আরামববাগের কৃষক উদয় চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘জমিতে চাষবাস করে কোনও লাভ নেই। ধান হোক, আলু হোক, কোনও চাষেই শান্তি নেই। অনেক সময় চাষের খরচ উঠছে না। তাই বাধ্য হয়েই চাষিরা জমি বেচে দিচ্ছেন।’

    ব্যবসায়ী বুলবুল রায় গুপ্ত বলেন, ‘এখন লোকজন শহরমুখী হয়ে যাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে অনেকে জমি কিনে বাড়িঘর করছেন। তাতে ভবিষ্যতে খাদ্যসঙ্কট হবে কি না, জানি না। তবে এটা আটকানো মুশকিল।’

    ইতিহাস বলছে, আরামবাগ মহকুমা গঠিত হয়েছিল ১৮১৯ সালে। তার আগে এই জায়গার নাম ছিল জাহানাবাদ। ১৯০০ সালের ১৯ এপ্রিল জাহানাবাদের নাম পরিবর্তন করে আরামবাগ রাখা হয়। যার অর্থ হলো, ‘স্বাচ্ছন্দ্যের বাগান’। আরামবাগের আশপাশে অনেক বড় বড় বাগান ও চাষের ছিল। সেখানে বিভিন্ন ধরনের চাষবাস হতো।

    আরামবাগ শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, কয়েক দশক আগেও এই মফস্বল শহরের আশপাশে প্রচুর কৃষিজমি দেখতে পাওয়া যেত। সেখানে ধান, আলু ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের আনাজ চাষ হতো। কিন্তু এখন আরামবাগ শহরের আশপাশে কৃষিজমি নেই বললেই চলে। অধিকাংশ চাষের জমি বিক্রি হয়ে গিয়েছে।

    আরামবাগ শহর থেকে যে রাস্তাটি কলকাতার দিকে চলে গিয়েছে তার দু’পাশে আর কোনও খালি জমি পড়ে নেই। জমির দামও অগ্নিমূল্য। আরামবাগ শহর থেকে কিছুটা ছাড়িয়ে বাসুদেবপুর মোড় থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চাষের জমির চিহ্ন মাত্র নেই। হয় সেখানে বসত বাড়ি তৈরি হয়ে গিয়েছে, নয় তো বড় বড় শোরুম, শপিং মল, পেট্রল পাম্প, গোডাউন কিংবা দোকান তৈরি হয়ে গিয়েছে। কোথাও আবার গজিয়ে উঠেছে হোটেল, রেঁস্তোরা, মার্কেট। আরামবাগ–তারকেশ্বর রেল লাইনের পাশেও বিঘার পর বিঘা চাষের জমি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।

    আরামবাগের প্রবীণ চাষি যজ্ঞেশ্বর রায় জানাচ্ছেন, আগে একবিঘা জমিতে ধান চাষ করতে খরচ হতো বড়জোর ৫ হাজার টাকা। তখন ধানের ফলনও বেশি হতো। তাতে চাষিরা লাভের মুখ দেখতে পেত। তার একটা বড় কারণ হলো, সেই সময় রাসায়নিক সার, মজুরি অনেক কম ছিল। পাম্প এবং ট্রাক্টরের খরচও এখনকার তুলনায় অনেকটাই কম ছিল। বাড়ির পুরুষ, মহিলা সবাই চাষের কাজে হাত লাগাত। তারা আর এখন কেউ মাঠে যায় না। সবটাই লেবারের উপর নির্ভর।

    চাষের কাজের জন্য দৈনিক মজুরি বেড়ে হয়েছে ৩০০–৩৫০ টাকা। তারা কাজের সময়ও কমিয়ে দিয়েছে। ফলে ধান চাষের খরচ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। বর্তমানে এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে খরচ পড়ে যাচ্ছে প্রায় ২০,০০০ টাকা। সেজন্য লাভের পরিমাণ কমে গিয়েছে।

    একই ভাবে আগে আলু চাষ করতে বিঘা প্রতি খরচ হতো ১০–১২ হাজার টাকা। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৩৫–৩৬ হাজার টাকা। যাঁরা মহাজন কিংবা সমবায় থেকে ঋণ নিয়ে চাষ করেন তাঁরা কোনও লাভের মুখ দেখতে পান না। সেজন্য নতুন প্রজন্ম আর চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

    জমি বিক্রি করে বিকল্প কাজ দেখে নিচ্ছে। পুরোনো চাষি সৌমেন কোলে বলেন, ‘চলতি বছরের ধান চাষ করতে বিঘা প্রতি আমার খরচ হয়েছে ২১ হাজার ৩২০ টাকা। আর ধান বিক্রি করেছি ১৮ হাজার ৪০০ টাকার। ঘরের টাকা খরচ করে কে আর চাষ করতে যাবে বলুন!’

  • Link to this news (এই সময়)