মুক্তিযুদ্ধে দাদু, কার্গিলে বাবা, ছেলেও সেনাতে, অপারেশন সিঁদুরের পর পুরুলিয়ার পরিবার বলছে, ‘যোগ্য জবাব’
প্রতিদিন | ১০ মে ২০২৫
সুমিত বিশ্বাস, কোটশিলা (পুরুলিয়া): ‘মুভ’! দু’অক্ষরের শব্দটা শুনলেই ৭৮-র বৃদ্ধ হয়ে ওঠেন জওয়ান। কান খাড়া হয়ে যায় তাঁর। টিন-টালির ছোট্ট ঘরে উত্তেজনায় কাঁপতে থাকেন। ঠিক একই শব্দে ২০ বছরের নাতি ‘ইয়েস স্যার’ বলে মার্চ পাস্টের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। সুদূর মহারাষ্ট্রের পুনের ন্যাশনাল ডিফেন্স একাডেমি ট্রেনিং সেন্টারে। আর মধ্যবর্তী প্রজন্ম সদ্য ৫০-এ পা দেওয়া ছেলের জীবনও ওই ‘মুভ’ শব্দতেই আষ্টেপৃষ্টে ঘেরা।
বাবা-ছেলে-নাতি। তিন প্রজন্মই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। বাবা ভূতনাথ গরাঁই, ছেলে সুধীরকুমার গরাঁই, নাতি শুভজিৎ গরাঁই। বাবা-ছেলে পাকিস্তানের সঙ্গে বিগত যুদ্ধে লড়াই করে অবসর নেন। আর নাতি কার্যত প্রস্তুত হচ্ছেন এমন যুদ্ধে যাওয়ার জন্য-ই। তাই পুরুলিয়ার কোটশিলার চাষ মোড়-তুলিন রাজ্য সড়কে ঠিক কোটশিলা স্টেশনের উলটোদিকে জিউদারু মৌজার দু’কামরার ঘরে যেন সাম্বা সেক্টরের আবহ! রাভি নদীর শীতল জলেও ওই নিয়ন্ত্রণ রেখার চারপাশ যেমন বারুদের গন্ধ। তেমন-ই শুকিয়ে যাওয়া কাঁসাই-র পাশে ওই কোটশিলার ঘরেও যেন যুদ্ধের আঁচ লেগেছে। বৃদ্ধের চোখের সামনে যে ভেসে আসছে সেই একাত্তরের স্মৃতি। মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে থাকার সময় সিনিয়রের ওই ‘মুভ’ শব্দটাতেই তিন মিনিটে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
৭৮-র প্রাক্তন সেনা কর্মী বলছেন, “ঘরে মন টিকছে না। মনে হচ্ছে চলে যাই ওই সাম্বা সেক্টরে। এই বয়সে আমাদেরকে তো আর যুদ্ধে নেবে না! অস্থায়ী ছাউনির রান্নাঘরে ওদের খাবার বানিয়ে দেব। সবজি কেটে দেব। যাতে ওদের খাওয়া-দাওয়ার কোন কষ্ট না হয়।” ওই ঘরের সদর দরজার সামনে টুলে বসে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন কথাগুলো।”তখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। তেমন ঠান্ডা। গোয়ালিয়রের ক্যাম্পে আমাদেরকে হঠাৎই বলা হলো ‘মুভ’। সঙ্গে সঙ্গে আমরা প্রস্তুত। উৎসুক মন জানতে চাইছে কোথায় যাচ্ছি আমরা? তবে আর্মি ট্রাকে বসার কিছুক্ষণ পর বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমাদের গন্তব্য। তিন দিন পর আর্মি ট্রাকে পৌঁছালাম সাম্বা। একেবারে পাক সীমান্ত ঘেঁষে অস্থায়ী ছাউনিতে।” প্রাক্তন সেনা কর্মী ভূতনাথ গরাঁই ছিলেন সিগন্যাল ম্যান। কনস্টেবল পদমর্যাদার সেনা কর্মী। বিধি অনুযায়ী সিগন্যালমানের হাতেও থাকতো থ্রি নট থ্রি রাইফেল। ব্যাটেলিয়ন থেকে হেড কোয়ার্টার। হেড কোয়ার্টার থেকে ব্যাটেলিয়ন। আবার ব্যাটেল ফিল্ড থেকে হেড কোয়ার্টার। স্যাটেলাইট, ওয়ারলেস, ওয়াকিটকিতে গোপন বার্তা আদান-প্রদান।
কেমন ছিল সেইসব বার্তা? মুখের দিকে বড় বড় চোখে চুপ করে তাকিয়ে থাকেন বৃদ্ধ। কিছুক্ষণ পর বলে ওঠেন, “ওইসব বার্তা বাইরে বলার নয়। এ বিষয়ে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করবেন না।” অবসর নিয়েছেন ১৯৮০ সালের সেই ৬ জানুয়ারি। ২৫ বছর পরেও গোপন বার্তার একটা শব্দ বলতেও নারাজ বৃদ্ধ। এতটাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি তাঁর আনুগত্য। তবে ভারত- পাকিস্তানের সেই ৭১-র যুদ্ধের অনেক কথা-ই বলে গেলেন তিনি। সাম্বা সেক্টরে থাকা রাভি নদীর ওপর সেতু বাঁচাতেই সেখানে অস্থায়ী শিবির গড়ে তাঁরা সিগন্যালের ডিউটিতে ছিলেন। সেই সঙ্গে ওই সেতুরও নজরদারি চলত। কিছুটা দূরে ছিল লাইন অফ কন্ট্রোল। সেবার ১৭-১৮ দিন যুদ্ধ চলে। তার মধ্যেই একদিনে ১০-১২ বার বোম্বিং করার চেষ্টা করে পাকিস্তান। কিন্তু সফল হয়নি। তাঁর কথায়, “একটি যুদ্ধবিমানকে আমরা ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। তবে সেটি পড়েছিল পাকিস্তানের ভূখণ্ডেই।” যুদ্ধ শেষের পরেও ওই এলাকা পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য ৬ মাস সেখানে ডিউটি করতে হয়। প্রায় আট মাস পর সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর কাছে বাড়িতে আসতে পেরেছিলেন ওই বৃদ্ধ সেনা কর্মী। ওই ছাউনিতে জয়ের উৎসব সেভাবে না হলেও তা গ্রামের বাড়িতে হয়। এক্স- সার্ভিস ম্যান আইডেন্টিটি কার্ডে সাদা-কালো ছবিতে সেনাবাহিনীর পোশাকে ৭৮-র ভূতনাথ গরাঁই-র একেবারে পেটানো চেহারা। সেখানে জ্বলজ্বল করছে জন্ম তারিখ। ১৯৪৭ সালের ৭ জুন। ব্রিটিশ শাসনের ভারতে তখনও যুদ্ধ। কর্মজীবন থেকে অবসরেও সেই যুদ্ধের উত্তেজনা জড়িয়ে রয়েছে বৃদ্ধ সেনা কর্মীকে। তাঁর কথায়, “বৃহস্পতিবার রাতে ভারত যেমন জবাব দিয়েছে। এমন জবাব দেওয়া দরকার ছিল আরও আগে। তাহলে হয়তো পেঁহেলগাও, পুলওয়ামা হতো না। ” গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে বৃদ্ধ-র। সাম্বা সেক্টর দিয়েই যে বৃহস্পতিবার অনুপ্রবেশকারীরা ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু যোগ্য জবাব দেয় সেনা! ১৯৬৪ সালে ওই প্রাক্তন সেনাকর্মীর সেনাবাহিনীতে যোগদান। ৬৫ থেকে মধ্যপ্রদেশের জব্বলপুরে প্রশিক্ষণ শুরু। আর ওই ৬৫ তেও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সাক্ষী থেকেছেন তিনি। জরুরীকালীন অবস্থায় প্রশিক্ষণরত তাঁদেরও রিজার্ভ রাখা হয়। ১৯৬৫-র সেই রক্ষা মেডেলও বৃদ্ধের হাতে। উলটে পালটে দেখছেন ১৯৭১ যুদ্ধ জয়ের পর পশ্চিমী স্টার ও সংগ্রাম মেডেলটিকেও। সেই সঙ্গে আরও তিনটি। একেবারে যত্ন করে রাখা।
ছেলে সুধীরকুমার গড়াই-র ১০ টা মেডেলও থরে থরে সাজানো। ১৯৯২ থেকে ২০২২। ৩০ বছর সেনাতে থেকে ১৯৯৯-এর এমন মে মাসেই কারগিল যুদ্ধে লে সেক্টরে ‘অপারেশন বিজয়’-এ ছিলেন তিনি। কেমন ছিল সে সব দিন? “তিন মাস চলেছিল যুদ্ধ। হাতে ইনসাস থাকলেও পাক গোলা বর্ষণ-এ প্রথম প্রথম ভয় লাগতো। তারপর সিগন্যালের কাজে এতই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে বিপদ, ঝুঁকি থাকলেও ভয় উধাও হয়ে যায়। কার্গিল তো দখলে নিতে হবে!” আর সিগন্যালের কথা? “না, ওসব বলতে পারব না। সেনাবাহিনীতে আমাদের শেখানো হতো রেস্পেক্ট অল, সাসপেক্ট অল।” বাবা সিগনাল ম্যান হিসেবে অবসর নিলেও ছেলে জুনিয়র কমিশন অফিসার হিসাবেই অবসর নেন। সেই সময় জব্বলপুর ট্রেনিং সেন্টারে ইন্সট্রাকটর ছিলেন তিনি। তাঁর কথায়,”পাকিস্তানকে এমন জবাব দেওয়া ভীষণ দরকার ছিল।” ছেলের কথার মাঝেই বৃদ্ধ বলে ওঠেন, “সেনাবাহিনী কখনও কোনও ভুল কাজ করতে পারে না। শুধু অপেক্ষা করে সরকারি আদেশের।”
আর এই আদেশের ওপরে ভর করেই পুনের ট্রেনিং সেন্টারে নাতি শুভজিৎ নিজেকে তৈরি করছেন। প্রাক্তন সেনা অফিসার সুধীরবাবু চেয়েছিলেন তাঁর একমাত্র ছেলেও যাতে সেনাতে যোগ দেয়। তাই হরিয়ানার আম্বালা আর্মি স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করার পরেই এনডিএ-তে সুযোগ আসে। চার বছরের এই প্রশিক্ষণে দু’বছর পার। আর বছর দুই পরেই সেনা অফিসার হয়ে শুভজিৎ আসবে এই জিউদারুর দু’কামরার ঘরে। গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে বৃদ্ধ প্রাক্তন সেনাকর্মীর। তবে মন পড়ে রয়েছে সেই পাক সীমানায়। লাইন অফ কন্ট্রোলে। সেই সাম্বা সেক্টরে। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে কি পতপত করে উড়বে ভারতের জাতীয় পতাকা? বিড়বিড় করে বলতে থাকেন বৃদ্ধ। “বয়স হয়েছে। আর বেশি দিন বাঁচব না। কিন্তু ওই ছবিটা দেখে যেতে চাই।” তাঁর কানে যে অবিরাম ধাক্কা লাগছে সেই দু’অক্ষরের ‘মুভ’ শব্দটাই!