সুদীপ জোয়ারদার
‘আমি আয়ুর শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছি। এইটাই আমার শেষকৃত্য, শেষ উপহার, শেষ উৎসর্গ…’। এ ভাবেই তাঁর লিখিত ভাষণ শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। উপলক্ষ, মেদিনীপুরে নবনির্মিত বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন। সময়টা ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর। আর বাংলা মতে, ১৩৪৬ সনের ৩০ অগ্রহায়ণ।
‘কবিকে রাজী করানো হইতে মেদিনীপুরে হাজির করানো পর্যন্ত সমস্ত দায়িত্ব’ ছিল সজনীকান্ত দাসের উপরে। সজনীকান্তের সঙ্গে তখন রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক খুবই ভালো। তাঁর রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক নানা কর্মকাণ্ডে কবি খুশি হয়ে তাঁকে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’র সম্পাদকমণ্ডলীতেও স্থান দিয়েছেন। ফলে এই বয়সে এত দূরের যাত্রায় কবিকে রাজি করানো শক্ত হলেও সজনীকান্তের পক্ষে তা অসম্ভব হয়নি।
তবু মেদিনীপুর যাত্রায় শেষ মুহূর্তে একটা বাধা এসে হাজির হলো। ঠিক ছিল, কবির জন্য মেদিনীপুরে একটা স্বতন্ত্র বাড়ির ব্যবস্থা করা হবে যাতে তিনি নিজের মতো করে থাকতে পারেন। কিন্তু খবর পাওয়া গেল, কবিকে থাকতে হবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের স্ত্রী চিরপ্রভা সেন শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রী। তিনি অতিথি হিসেবে কবিকে পেতে চান। এ দিকে, কবি থাকতে চান সম্পূর্ণ নিরালা একটি বাড়িতে নিজের ইচ্ছাধীনে। কবির ইচ্ছেকে অবশেষে মান্যতা দিয়ে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হলো রামগড়ের রাজার বাড়িতে।
কবির মেদিনীপুর যাত্রা উপলক্ষে ১৫ ডিসেম্বর সকালে একটা ফার্স্ট-ক্লাস বগিকে বোলপুর স্টেশনে হাজির করানো হলো। অনিল চন্দ, কৃষ্ণ কৃপালনী, অমিয় চক্রবর্তী, ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী প্রমুখকে নিয়ে কবি উঠে বসলেন। কবির সঙ্গে ক্ষিতিমোহন বসলেন এক কামরায়, অন্যরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করার জন্য চলে গেলেন পাশের কামরায়। গুসকরায় কবির কামরায় অন্যদের ডাক পড়ল। কবি ক্যাস্টর অয়েলে ভাজা পরোটা খাওয়ালেন তাঁদের।
ট্রেন হাওড়ায় পৌঁছতেই কলকাতা কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা এসে কবিকে নিয়ে গেলেন পুরসভার ‘খাদ্য ও পুষ্টি’ বিষয়ক অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করানোর জন্য। আগে থেকেই ঠিক ছিল, ওই অনুষ্ঠানে তাঁরা নিয়ে যাবেন এবং মেদিনীপুরগামী ট্রেন ছাড়ার আগে কবিকে স্টেশনে পৌঁছে দেবেন।
ইতিমধ্যে হাওড়া স্টেশনে কবির সঙ্গে যাওয়ার জন্য বাংলা শিল্প-সাহিত্যের সুপরিচিত ব্যক্তিরা একে একে এসে ভিড় জমালেন। সে এক চাঁদের হাট। কে নেই সেখানে? রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সাগরময় ঘোষ, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত সরকার এবং আরও অনেক খ্যাতিমান নবীন-প্রবীণ। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় আরও একজনের স্টেশনে কবির সঙ্গে দেখা করতে আসার কথা শুনেছিলেন, তিনি সুভাষচন্দ্র বসু। যদিও তাঁদের আলাপচারিতার বিবরণ কোথাও প্রকাশিত হয়নি।
সে দিন ট্রেন মেদিনীপুর পৌঁছয় রাত ১০টায়। ওই রাতেও প্রবল শীতকে উপেক্ষা করে বহু মানুষ স্টেশনে ভিড় জমান কবিকে দেখার জন্য। পরের দিন সকালে দেখা গেল, নবনির্মিত বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দিরে হাজির হয়েছে হাজার হাজার দর্শক। সে দিনের ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী, পরবর্তী কালে সাহিত্যিক হিসেবে সুপরিচিত, আজাহারউদ্দিন খান লিখেছেন, ‘আমাদের প্রধানশিক্ষক বিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্রকে স্কুলের সামনের রাস্তায় দু’ধারে লাইন করে শীতকালের সকালে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। …রবীন্দ্রনাথ বেলা ৯টায় আমাদের বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে হুড খোলা মোটরে আস্তে আস্তে চলে গেলেন স্মৃতি মন্দির উদ্বোধন করতে।’
তারপরে অগণিত দর্শকের সামনে অনুষ্ঠিত হল ঐতিহাসিক দ্বারোদ্ঘাটন অনুষ্ঠান। কবি বললেন, ‘বঙ্গ সাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোকে যদি স্বীকার করে থাকেন, তবে আমি যেন স্বীকার করি একদা তার দ্বারোদ্ঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’ তাঁর এই কথা শুনে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা রোমাঞ্চিত হয়ে পড়লেন। কবি আরও বললেন, ‘মেদিনীপুর তীর্থরূপ নিয়ে আমাকে আহ্বান করেছে এই পুণ্যক্ষেত্রে। …বঙ্গ সাহিত্যের উদয়-শিখরে যে দীপ্তিমানের আবির্ভাব হয়েছিল, অস্তদিগন্তের প্রান্ত থেকে আমি প্রণাম প্রেরণ করছি তাঁর কাছে।’
সজনীকান্ত লিখেছেন—‘‘উপক্রমণিকার’ পদপ্রান্তে ‘প্রান্তিকে’র নতি নিবেদন—সেই মহান দৃশ্য সেদিন যাঁহারা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন তাঁহারা সৌভাগ্যবান।’
ঋণ: আত্মস্মৃতি, সজনীকান্ত দাস
(লেখক শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক। মতামত ব্যক্তিগত)