সালটা ছিল ১৯৭১। সময় ডিসেম্বরের এক সকাল। আমি তখন ছিলাম গোয়ালিয়র সেনা শিবিরে। তার সাত বছর আগে ভারতীয় সেনাবাহিনী পরিবারের সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়ে গিয়েছি। ১৯৬৪ সালে যোগ দিয়েছিলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। তার পরের বছরেই হয়েছিল ভারত–পাকিস্তান যুদ্ধ। আমার তখন ট্রেনিং চলছে, তাই ছিলাম রিজ়ার্ভ হিসেবে।
তার পরে অপেক্ষা সাত বছরের। ডিসেম্বরের সাতসকালে নির্দেশ এসেছিল ‘মুভ’। এমন নির্দেশের অর্থ কী, সেটা বিলক্ষণ আমরা জানতাম। দ্রুত তৈরি হয়ে গেলাম। আমাদের বলা হয়েছিল, যেতে হবে কাশ্মীরের সাম্বা সেক্টরে। জায়গাটা পাক সীমান্ত লাগোয়া। তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। খবরটা পেয়েই কী অপূর্ব অনুভূতি যে হয়েছিল, তা বলে বোঝাতে পারব না। পাঠানকোট হয়ে পৌঁছলাম সাম্বা ক্যাাম্পে। তার পাশেই ছিল বাঙ্কার। অন্য রেজিমেন্টের সেনারাও পৌঁছে গেল সেখানে।
আমার কাজটা ছিল এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে অথবা কোনও ক্ষেত্রে সেক্টর থেকে হেডকোয়ার্টারে খবর পাঠানো। কাজটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দিন–রাতের কোনও ফারাক ছিল না। সেনাবাহিনীর নিজস্ব কিছু গোপন ‘কোড’ থাকে।
সেই অনুযায়ী বার্তা পাঠাতাম। এখনও মনে আছে, রাভি নদীর ধারে একটি সেতুর পাশে ছিল আমাদের ক্যাম্প। সারাক্ষণ দেখতাম, দু’দেশের বিমান উড়ে যাচ্ছে। থেকে থেকে সাইরেন বাজছে। আমাদের ক্যাম্প লক্ষ্য করেও পাক বিমান বোমা ফেলেছিল। কোনও কারণে সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ক্যাম্পের কিছুটা দূরে পড়ে। সেই সময়ে আমি বাঙ্কারে বসে খবর পাঠাচ্ছিলাম।
একবার তো পাকিস্তানের একটা ফাইটার বিমান আমাদের আকাশসীমায় ঢুকে পড়েছিল। ভারতীয় সেনা গুলি করে সেটা নামিয়েও ফেলেছিল, কিন্তু বিমানের পাইলট কোনওক্রমে সেই অবস্থায় বিমানটা ঘুরিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। সাম্বা সেক্টরে থাকার সময়ে খবর পেতাম, ভারতীয় সেনা সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে। আমরা উল্লাসে ফেটে পড়তাম। প্রায় ১৭–১৮ দিন যুদ্ধ হয়েছিল। তার পরে সিজ় ফায়ার ঘোষিত হলো।
তবে তার পরেও ছ’মাস ওখানে থাকতে হয়েছিল। আট মাস পরে বাড়ি ফিরেছিলাম। পরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক থেকে পেয়েছিলাম সংগ্রাম মেডেল, পশ্চিমী স্টার পদক, রক্ষা পদক, সৈন্য সেবা পদক।
আমাকে দেখেই ছেলে সুধীর স্কুলে পড়তে পড়তেই ঠিক করে নিয়েছিল, যোগ দেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। ১৯৯২ সালে ও সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। নানা জায়গা ঘুরে ছেলে যখন কাশ্মীরের লেহ–তে পোস্টিং পেল, তখন তো কার্গিল সংঘর্ষ শুরু হয়ে গিয়েছে। ও–ও ছিল সিগন্যাল বিভাগে।
ছেলেরও নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে। গোপনতম বার্তা আদান–প্রদান করতে হয়েছে ছেলেকেও। তার পরে ২০২২ সালে ছেলে অবসর নিল সেনাবাহিনীর ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে। সুধীরও কর্মজীবনে ‘অপারেশন বিজয়’ এবং ‘অপারেশন পরাক্রম’ অভিযানে অংশ নিয়েছে। আমার গর্ব যেন দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল।
এখন তো নাতি শুভজিৎ যোগ দিয়েছে সেনাবাহিনীতে। আম্বালা আর্মি স্কুল থেকে পাশ করেছে। ২০২৩ সালে পুণের ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমিতে (এনডিএ) যোগ দিয়েছে।
দেশের জন্য নিজেদের সমস্ত কিছু উজাড় করে দেওয়াই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। দেশের সেবা করার মতো তৃপ্তি আর কীসেই বা রয়েছে! এত বড় একটা দেশের সাধারণ মানুষ তো আমাদের মতো জওয়ানদের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। আমাদের বিশ্বাস করেন, সাহস দেন, স্বস্তি অনুভব করেন। আমরাও তো তাঁদের আস্থার মূল্য দিতে তৈরি।
পহেলগামে পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীদের হামলার ঘটনা কিছুতেই মানতে পারি না। ভারতীয় সেনাবাহিনী উপযুক্ত জবাব দিচ্ছে। আমাদের সেনা কখনও ভুল করে না, করতে পারে না। মনেপ্রাণে বিশ্বাস রাখি, যুদ্ধ যদি আবার পুরোদমে শুরুও হয়, জয় হবে আমাদেরই।