সব্যসাচী ঘোষ, মালবাজার
১৯৪৩-৪৪ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবলে গোটা বিশ্ব। বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়েজ়–এর গুরুত্বপূর্ণ জলপাইগুড়ি জেলার মাল জংশন। বাবা স্টেশন মাস্টার। স্টাফ কোয়ার্টার দূরে, ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের কোয়ার্টার স্টেশনের খুব কাছে। ক্রিকেট খেলতে ভালবাসতেন তিনি। আজ যেখানে সরকারি আবাসন, সেখানে ছিল প্রকাণ্ড মাঠ। আর এক দিকে সাহেবদের পোলো ক্লাব। সেই মাঠে ছেলেবেলায় ক্রিকেট খেলছিলেন ছোট্ট শীর্ষেন্দু। বল গিয়ে পড়ে পিছনের ঝোপে। খুঁজতে গিয়ে ভেঙে পড়া জাপানি যুদ্ধ বিমানের খোল দেখতে পান তিনি। আরও কাছে গিয়ে দেখেন, সেই খোলের নীচে দুই ফুটফুটে চিতাবাঘের শাবক সেই বল নিয়ে খেলছে। জীবনে সেই প্রথম ‘বাঘ’ দর্শন।
কোয়ার্টারের কাছে আরও একটি রেলের নিজস্ব মাঠ। সেই মাঠ এখন আড়েবহরে যা হয়েছে, তখন নাকি দ্বিগুণেরও বড় ছিল। দিনের বেলায় শেয়াল মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকত। জলপাইগুড়ির কাছে তিস্তার বিপরীত পাড়ে রেলের শহর দোমোহনিতে রেল কোয়ার্টারে, শীর্ষেন্দুর শৈশবের অনেকটা কেটেছে। সেই দোমোহনির অনুষঙ্গে বেশ কিছু গল্প, বিশেষ করে ভূতের গল্প তিনি লিখেছেন। কিন্তু ৬৮–র তিস্তার বন্যায় দোমোহনির অনেক কিছু নষ্ট হয়। তাই শীর্ষেন্দুর স্মৃতিমাখা মালবাজার রেল কোয়ার্টারকে হারিয়ে যেতে দিতে চান না স্থানীয়রা।
এই মালবাজারের কোয়ার্টারে থাকার দিনগুলোতে বালক শীর্ষেন্দুর একদিন প্রচণ্ড জ্বর হয়। রাতে বাড়াবাড়ি খুব। সারা রাত রেলের ডাক্তার শিয়রে বসে। জ্বরের ঘোরে দেখছেন, সেবকের করোনেশন সেতুর দুই প্রান্তে বাঁধা এক দোলনা। তিস্তার জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দোল খাচ্ছেন। আর তাঁকে নিশানা করে কেউ বন্দুক তাক করে গুলি ছুড়ছে। যেহেতু তিনি দোল খাচ্ছেন, তাই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে। ভোরবেলা যখন বাবা-মা, রেলের ডাক্তার, সকলের বিনিদ্র চোখগুলোর দিকে তাকালেন, তখন তাঁর জ্বর কিছুটা কমেছে। কথা বলছেন। শীর্ষেন্দুর স্বপ্নের কথা শুনে রেলের সেই ডাক্তারের মন্তব্য, ‘স্বপ্নের মধ্যে একটা গুলিও যদি শরীর স্পর্শ করত, তা হলে আর চোখ মেলতে হতো না।’ সেই সব স্মৃতির রেল আবাসটি আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে, তবে পরিত্যক্ত কোয়ার্টার হিসেবে। আগাছার জঙ্গলে ঢেকেছে এলাকা।
শীর্ষেন্দুর বাবা রেলে চাকরির সূত্রে বিভিন্ন এলাকায় থেকেছেন। তার মধ্যে জলপাইগুড়ির দোমোহনি উল্লেখযোগ্য। তিস্তার বাম পাশের দোমোহনি রেলের শহর হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ আমল থেকেই দোমোহনির গুরুত্ব বেড়ে ওঠে। মালবাজার যদি শিশু শীর্ষেন্দুর বিচরণ হয়, তা হলে দোমোহনি ছিল কিশোর শীর্ষেন্দুর প্রথম চারণক্ষেত্র। ১৯৬৮–তে তিস্তার প্রলয়ঙ্করী বন্যায় দোমোহনির অনেক কিছুই জলের তলায় চলে যায়। বড় শহরের স্বপ্নেরও সেখানেই সমাধি হয়। এবং শীর্ষেন্দুর আবাসের ইতিহাসও তাই সেখানে মুছে গিয়েছে। কিন্তু আজও অবিকল মালবাজারের রেল কোয়ার্টারটি রয়ে গিয়েছে। ব্রিটিশ আয়রনের প্ল্যাংকিং ও সেই যুগের টিন ও কাঠের বাংলো প্যাটার্নের এই কোয়ার্টারটি দু’দশক ধরে পরিত্যক্ত। কোয়ার্টারের সামনে বিস্তৃত ফাঁকা জায়গা। বাগান করার জন্যেই হয়তো সেই ভাবে ফাঁকা রাখা ছিল। পিছনে একটি ছোট জলাশয় ছিল, সেটাও পরে মজে যায়।
২০১৭-১৮ সালে জলপাইগুড়ি জেলা বইমেলার আসর বসেছিল মাল বাজারে। উদ্বোধনে এসে তাঁর শৈশবের রেলের আবাসনটিকে চিহ্নিত করে চোখের জল ফেলেছিলেন প্রবীণ সাহিত্যিক। রেলের সেই আবাসটি যদি সংরক্ষণ হতো তাহলে অত্যন্ত খুশি হতেন। দোমোহনিতে যা হয়েছে, মালবাজারেও সেই একই ঘটনা হোক, চান না শহরবাসী। রবীন্দ্র পরবর্তী অধ্যায়ে, স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের নানা ছবি, কীর্তি সম্বলিত তাঁর ছোটবেলার প্রিয় কোয়ার্টারে রক্ষিত হোক, সেটাই চাইছেন তাঁরা। হারিয়ে ফেলার আগে যেন শীর্ষেন্দুর কোয়ার্টারের উজ্জ্বল উদ্ধারটুকু হয়ে থাকে।
যাঁকে নিয়ে এত আলোচনা, তিনি অবশ্য সব শুনে মুচকি হেসেছেন। শীর্ষেন্দু বলেন, ‘বাবা কাটিহার থেকে মালবাজার গিয়েছিলেন। মাল স্টেশন জংশন নামেই পরিচিত ছিল। সে সময়ে কোয়ার্টারের কাছে এক দিকে চা বাগান, অন্য দিকে খেলার মাঠ। সেই খেলার মাঠে চিতাবাঘ রোদ পোহাতে আসত। অল্প দূরে বিশ্বযুদ্ধের জন্যে মার্কিন সেনাদের একটি অস্থায়ী ছাউনি ছিল। সব যেন মনে হয় সেই দিনের কথা! কিন্তু মাঝে এক নিমেষে কতটা সময় চলে গিয়েছে।’