সুমন ঘোষ, খড়্গপুর
গুলিগোলা চালানোর বয়স আর নেই। তবু এই তাঁর একান্ন বছরের মনটা আগের মতোই সতেজ। মনে করেন প্রাক্তন সেনাকর্মী শঙ্করকুমার মণ্ডল। আমেরিকায় মধ্যস্থতায় ভারত-পাকিস্তানের চলতি সংঘর্ষে শনিবার বিরতির ঘোষণা করেছে দুই দেশ। কিন্তু কোনও কারণে যদি আবার সীমান্তে ডাক পড়ে তখন কী করবেন?
প্রশ্ন শুনে এক সেকেন্ডও সময় নিলেন না প্রাক্তন সেনাকর্মী শঙ্করকুমার মণ্ডল। সাফ জানালেন, ‘যার নুন খেয়ে বড় হয়েছি তাকে কখনও ভুলব না। দেশের জন্যে সব করতে রাজি। যদি সীমান্তে ডাক পেতাম, এক পায়ে রাজি হতাম।’
১৯৯৪ সালে সিপাহি হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবং ব্লকের দশগ্রামের শঙ্কর। বাহিনীর নানা গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে অংশ নেন তিনি। চাকরিতে যোগ দেওয়ার বছর পাঁচেক পরেই ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধ। পাকিস্তান সীমান্তে তখন তীব্র গুলির লড়াই। যুদ্ধ ঘোষণার আগে দু’মাসের ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। জরুরি বার্তা পেয়েই ২৮ দিন ছুটি কাটানোর পর ফিরে যান ওয়াঘা সীমান্তে। নিজের কর্মস্থলে।
স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বললেন, ‘গমের খেতে টানা তিনমাস কেটেছে। সারাক্ষণ শুধু মাইন পোঁতার কাজ করতে হয়েছে। যাতে শত্রুপক্ষ কোনও ভাবে ভারতে ভুখণ্ডে ঢুকলেই বিস্ফোরণ ঘটে। কাজ করতে করতে খাবার সময়টুকুও মেলেনি।’
তিনি এক্সপার্ট ছিলেন ৮১ এমএম মর্টার চালানোতেও। জানালেন, ওই মর্টার থেকে ৩৬০ ডিগ্রিতে পাঁচ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তু স্থির করে মর্টার ছোড়া যায়। যার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল প্রায় ৫০০ মিটার।’ শঙ্কর জানালেন, ৫০ কিলোমিটার জুড়ে পাকিস্তানকে ব্যারিকেড করা হয়েছিল সে সময়।
তাঁর কথায়, ‘যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও টানা এক বছর কড়া নজর রাখতে হয়েছিল সীমান্তে। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছিল সবকিছু।’ উরি সেক্টরের বারামুলায় কী ভাবে অ্যামবুশ করে ৮-৯ জন জঙ্গির সঙ্গে রুদ্ধশ্বাস লড়াই চালিয়েছিলেন তাও তাঁর মনে পড়ে গেল নিমেষে। প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকি নিয়েই লড়াই চালিয়েছিলেন পাহাড়, জঙ্গল, বরফে। গুলির লড়াইয়ে নিজেদের বাঁচিয়ে জঙ্গিকে কখনও জীবিত ধরেছেন, আবার কখনও ঝাঁঝরা করে দিয়েছেন পাল্টা গুলির লড়াইয়ে।
অসমে বোড়ো জঙ্গি দমন অভিযানেও গিয়েছিলেন। কঙ্গোয় ভারতীয় শান্তি সেনা হিসেবে কর্তব্য পালন করেছিলেন। কী ভাবে অস্ত্রধারী জঙ্গিদের মূল স্রোতে ফিরিয়েছিলেন সে গল্প শোনাতে গিয়ে বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই কাজটি হত রাতের অন্ধকারে। আমাদের ক্যাম্পে লাগানো থাকতো দামি স্ক্রিন। অনেক দূরের কেউ এলেও যা পরিষ্কার দেখা যেত ক্যাম্পে বসেই। কিছুটা আসার পরই দোভাষী দিয়ে বলা হত, তাঁরা যেন অস্ত্র-সহ দু’হাত তুলে এগিয়ে আসে। তারপর অস্ত্র নিয়ে নেওয়া হত। তাদের রাখা হত বিশেষ ক্যাম্পে।’
একের পর এক পদোন্নতি ঘটতে ঘটতে নন–কমিশনড অফিসার পদে পৌঁছে যান। তারপর ২০১০ সালে অবসর। এখন রেলে চাকরি করেন। কাজের ফাঁকেই সারাক্ষণ সীমান্তের খবর রাখছিলেন। তবে এ দিন বিকেলে দু’দেশের মধ্যে সংঘর্ষবিরতির ঘোষণা হতেই তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘সংঘর্ষবিরতির ঘোষণা করেছে ভালো কথা।’