সব্যসাচী ঘোষ, মালবাজার
গোটা গ্রাম এখন খাঁ খাঁ করছে। সামান্য দূরে দু’হাত তুলে যেন বরাভয় দিচ্ছে প্রকাণ্ড চুইখিমের সবুজ পাহাড়। কিন্তু তাতেও আশ্বাস মিলছে কি? কাটছে কি ভয়? কারও সন্তান, কারও জামাতা, কারও ভাই এখন রণাঙ্গনে।
গভীর রাতেও ওঁরা সীমান্তের কাছাকাছি অতন্দ্র প্রহরায় দাঁড়িয়ে। তবু সেই সেনাদের বাবা-মা–দাদারা চোখের কোণে ভয় লুকিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে বলছেন— কুছ পরোয়া নেই, তাঁদের লক্ষ্য শুধু পাকিস্তানের পরাজয়।
এটা সৈনিকদের গ্রাম। একদা ছিল চা শ্রমিক মহল্লা। সৈনিকদের মহল্লা বলেই এখন পরিচিত। গত তিন দশকে মালবাজার ব্লকের বাগরাকোট চা বাগানের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে–থাকা শ্রমিক পরিবারের সন্তানেরা দলে দলে যোগ দিয়েছেন ভারতীয় সেনায়। স্থলসেনা, বায়ুসেনা, নৌসেনা এবং সাম্প্রতিক সময়ে অগ্নিবীরেও এই এলাকার প্রতিনিধিত্ব রয়েছে।
প্রায় ২০০ পরিবারের প্রতিটি ঘর থেকে একজন করে সেনা জওয়ান রয়েছেন বাহিনীতে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁদের পোস্টিং। অনেককেই এখন পাকিস্তান উপদ্রুত সীমান্তে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাগরাকোটের বাসিন্দা কবীর থাপা সস্ত্রীক ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধেয় ছুটি বাতিল হয়ে যায়। তখনই তাঁরা বেরিয়ে পড়েন। রাতের রান্না পাড়া–পড়শিদের বিলিয়ে তালা বন্ধ করে চলে গিয়েছে থাপা পরিবার। এখানকার পরিচিত মুখ অজয় খারকা-র ভাই, জামাইবাবু মুহূর্তে সেনায় রয়েছেন। তাঁদের জন্য ভয় নয়, বরং গর্ব হচ্ছে বলে জানান অজয়।
বাগরাকোট চা বাগানের অবসরপ্রাপ্ত চা শ্রমিক ভোলানাথ শর্মার ২৩ বছর বয়সি একমাত্র ছেলে রোহিত শর্মা অগ্নিবীর পদে রয়েছেন। এই মুহূর্তে তিনি রয়েছে জম্মুতে। সাত দিন ধরে ছেলের সঙ্গে কোনও কথা হয়নি ভোলানাথের। রাতে রোহিতের বৃদ্ধ বাবা, মা ও দিদি দু'চোখের পাতা এক করতে পারেন না। তারপরেও ভোলানাথ বলেন, ‘দেশের প্রতি, সেনাবাহিনীর প্রতি কর্তব্যে ছেলে যেন অবিচল থাকে। সে জন্য সর্বোচ্চ বলিদান দিতে হলেও আমার ছেলে দেবে, সেটাই চাইছি।’
গ্রামের একধারে কাঠের তৈরি ছোট্ট মণিহারি দোকান। দোকানের ভিতরে আরও ছোট টেলিভিশন সেট যুদ্ধের ধারাবিবরণী শোনাচ্ছে। সেখানেই স্থির চোখ রেখেছেন বৃদ্ধা সাবিত্রী ভুজেল। সাবিত্রীর জামাতা অরুণ প্রতাপ সীমান্তে পৌঁছেছেন। সাবিত্রী বলেন, 'পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের দেশ। ওদের যে কোনও মূল্যে চরম শিক্ষা দিতেই হবে।'
ভারতীয় সেনাবাহিনীর গোর্খা রেজিমেন্টের সৈনিকরাই বেশি রয়েছে গ্রামে। তাঁরা জয় মহাকালী স্লোগানে মুখরিত করছেন সীমান্তকে। ওদের বৃদ্ধ বাবা-মা আঁকড়ে রয়েছেন সেনাদের গ্রামকে। সে দিনের আশায় রয়েছেন ওঁরা, যে দিন খোকা এসে বলবে— ‘এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে/ ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে/ আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে/ বলছি এসে, 'লড়াই গেছে থেমে।’