দিলীপ মহান্তী
নব্বইয়ের দশকে আমরা স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে কলেজের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। দু’পাশে দিগন্ত প্রসারিত মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, গাছপালা আর অসীম আকাশ আমাদের দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছিল। ঘর থেকে রাস্তায়, রাস্তা থেকে অচেনা, অজানা প্রদেশে। সেই সময়ে এক বৈশাখে কবিতার সঙ্গে দেখা, জ্যৈষ্ঠতে পরিচয়। আষাঢ়ে প্রেমে পড়া। তারপর থেকে ‘শ্রাবণের ধারাজলে মুখর হৃদয় তালীবনদিঘি কল্লোলে অবিরাম...।’
সেই সময়ে মেদিনীপুরে কবিতার তুলো উড়ছে। ধূলি-ধূসরিত সেই রাস্তায়, পুরোনো প্লাস্টার খসা দেওয়ালের গায়ে লেপ্টে থাকা ইতিহাস আমাদের ঐতিহ্য সচেতন করে তোলে। ভেতর থেকে উথলে ওঠে শিকড়ের গান ও ঘ্রাণ। শহরের প্রবীণ কবিরা আমাদের পথ দেখান। শহর থেকে প্রকাশিত কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক আমাদের সাহিত্যের আকাশে তারা চেনান।
তখন মেদিনীপুর শহর থেকে বেশ কিছু ভালো পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সমীরণ মজুমদার সম্পাদিত ‘অমৃতলোক’, বিপ্লব মাজী সম্পাদিত ‘সময় সরণি’, আজহারউদ্দিন খান সম্পাদিত ‘শব্দের মিছিল’, দীপক কর সম্পাদিত ‘ধানসিড়ি’ বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়াও প্রকাশিত হতো ‘আয়ুধ’, ‘অস্তিত্ব’, ‘এবং অর্বাচীন’, ‘সমকালীন’ প্রভৃতি। নব্বই দশকের প্রায় শেষের দিকে ‘জ্বলদর্চি’ও মেদিনীপুর শহর থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করল। এই সব পত্রিকায় যেমন সারা রাজ্যের কবিরা লিখছেন, তেমনই শহরের প্রভাকর মাঝি, অমর ষড়ঙ্গী, বীতশোক ভট্টাচার্য, বিপ্লব মাজী, প্রভাত মিশ্র, দীপক করের মতো কয়েকজন বিখ্যাত কবিও লিখছেন।
বীতশোক ভট্টাচার্য বড়বাজারের বাসন্তীতলার গলি থেকে শাসন করছেন বাংলা কবিতাকে। সমীরণ মজুমদার ‘অমৃতলোক’-এর একটার পর একটা গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা করে সারা রাজ্যে সমীহ আদায় করে নিচ্ছেন। বিপ্লব মাজী ও প্রভাত মিশ্রও ভালো কবিতা লিখছেন, তাঁদের মৌলিকতাও প্রশংসিত হচ্ছে। আর ওঁদের ছত্রচ্ছায়ায় একদল তরুণ কবি কবিতা নিয়ে অন্য ভুবন গড়তে চাইছে। প্রতি বছর কবিতা উৎসব হচ্ছে। কবিতা নিয়ে পদযাত্রা হচ্ছে। রাজনীতিও থেমে থাকছে না।
আমরা তখন মেদিনীপুরের রাস্তায় অঘোষিত কবি। সেই সময়ে মউলি মিশ্র, রোশেনারা মিশ্রের মতো দু’-একজন কম বয়সেই বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল। আমরা এখন কেউ ঘরের কোণে, কেউ চাকরিসূত্রে শহর ছাড়া। ‘তরুণ কবি’ পরিচিতিটাও কালের নিয়মে হাতছাড়া। কিন্তু মেদিনীপুরের আকাশ, বাতাস, মাটি আমাদের বুকের গভীরে। স্বপ্নঘেরা সেই দিনগুলোর স্মরণে বলা যায়— ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে...।’
মেদিনীপুর শহরের বুকে কয়েকটি রাস্তা ছিল গোপন কথার মতো। এখনও আছে। এই সব রাস্তাঘাটে কবিতা ছিল, আর বাতাসে ভেসে বেড়াত এক অজানা শিহরণ। কাঁসাইয়ের রেলসেতু, গোপগড়ের উঁচু টিলা ও জঙ্গল, জেলখানার পাশে তেঁতুলতলার মাঠেও বসন্ত ছিল। এই সব স্থান আকাশপ্রদীপ হয়ে জ্বলত দূরের তারার দিকে চেয়ে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামত। ঝরে পড়ত কবিতার ফোঁটা।
এই প্রজন্মের প্রেমিক-প্রেমিকারা বদলে গিয়েছে। তখনকার প্রেমিক-প্রেমিকাদের আত্মার আত্মীয় ছিল নন্দিনী-শুভঙ্কর, অনিমেষ-মাধবীলতা, সুমনের গান, রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও পূজা পর্যায়ের গান, চন্দ্রবিন্দুর গান। অনেক কিছু নেই, তবু প্রেম আছে, হয়তো কবিতাও আছে। এ ভাবেই ঈশান কোণে জমছে অন্ধকার।
তখন আমাদের বিছানায় বালিশের পাশে মোবাইল নয়, স্তরে স্তরে সাজানো থাকত শক্তি, সুনীল, শঙ্খ, বিনয়, পূর্ণেন্দু, প্রণবেন্দুর কবিতা। সে ছিল প্রেমপত্রের যুগ। পিয়নের জন্য অন্তহীন অপেক্ষায় দগ্ধ প্রহর কাটত। সেই পাওয়া না-পাওয়ার মাঝখানে, সেই অপেক্ষার মুহূর্তে দ্বিধা থরথর চূড়ায় ভর করত সাতটি অমরাবতী। সেই মনকেমনের আগুনে পুড়ে যেত ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’-এ মোড়া আবেগের স্বর্ণ গোধূলি।
আমাদের মনের কথাটি শঙ্খ ঘোষ লিখে দিয়েছিলেন। শহরের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের যেন আমাদের বলতে ইচ্ছে করত— ‘তুমি কি কবিতা পড়ো? তুমি কি আমার কথা বোঝো?/ ঘরের ভিতরে তুমি? বাইরে একা বসে আছো রকে?/ কঠিন লেগেছে বড়ো? চেয়েছিলে আরো সোজাসুজি?/আমি যে তোমাকে পড়ি, আমি যে তোমার কথা বুঝি।’ এই লাইনগুলোতে আমাদের সমবেত ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ শোনা যেত।
পঞ্চুরচকে, জেলা পরিষদের সামনে, বটতলায়, জল ট্যাঙ্কের মোড়ে, স্টেশন রোডের মিষ্টিঘরের আড্ডা মুখরিত থাকত কবিতাকর্মীদের সৌজন্যে। এখনও হয়তো আড্ডাগুলো আছে। শুধু পাল্টে গিয়েছে মুখগুলো। আর শহরের মেসগুলোতে ছিল উজ্জ্বল শাণিত চোখের মেধাবী দৃষ্টির ঝলকানি। স্বপ্ন দেখা সেই চোখে ছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য।
পঞ্চুরচক থেকে এলআইসি মোড় পেরিয়ে বাসস্ট্যান্ড, ফকির কুয়ো ছুঁয়ে রেললাইন অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা রহস্যঘেরা গোপগড়ে পৌঁছত, সেই রাস্তাই পৃথিবীর পথ। তার ও পারে রামায়ণ-মহাভারতের দেশ। সেটাই তো আমাদের ভারতবর্ষ।
(লেখক অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক। মতামত ব্যক্তিগত)