বঙ্গ বধূদের সিঁথি রাঙাতে বাংলার গোকুলে বাড়ছে মার্কিন সিঁদুর বৃক্ষ
বর্তমান | ১৩ মে ২০২৫
সুখেন্দু পাল, বর্ধমান: কেমিক্যাল রংয়ের বিরুদ্ধে এ এক অন্য ‘অপারেশন সিঁদুর’! ‘বন্ধু’ দেশ মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা!
প্রাচীন যুগে সিঁদুর তৈরি হতো একেবারে ভেষজ উপায়ে। মূল উপাদান হলুদ, চুন কিংবা ফিটকিরি। তার সঙ্গে মেশানো হতো লাল চন্দনের গুঁড়ো অথবা জাফরান। কুমকুম নামে সেই সিঁদুরের সুখ্যাতি পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিল আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ও বেদ-বৈদিক সাহিত্যে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেই আয়ুর্বেদিক গরিমা হায়ায় ‘সৌন্দর্য লহরী’। মায়েদের সিঁদুর-সৌন্দর্য সিঁথিকে এই নামেই মর্যাদা দিয়েছিলেন আদি শঙ্করাচার্য। এখন নানা রাসায়নিক যৌগের সংমিশ্রণে তৈরি হয় সিঁদুর। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আবার অতিরিক্ত মুনাফার লোভে উচ্চ মাত্রায় রেড লেড বা লাল সিসা মিশিয়ে থাকে। যা অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এবার এই কেমিক্যাল মিশ্রিত সিঁদুরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বাংলায় বেড়ে উঠছে সিঁদুর গাছ। জন্ম মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকায়। ইতিমধ্যেই নদীয়ার ফুলিয়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, দুর্গাপুর সহ বিভিন্ন জায়গাতেই চাষ হচ্ছে। চাহিদা বুঝে নার্সারি গুলিতেও তৈরি হচ্ছে চারা। ফলে, আর কিছুদিনের মধ্যেই বাংলার মা-বোনেদের ললাটে ও সিঁথিতে উঠবে সিঁদুর গাছের ফল থেকে তৈরি হওয়া ভেষজ সিঁদুর। অর্থাৎ, প্রাচীন ঐতিহ্যেই ফিরছে নারীর ললাটের ‘উদীয়মান সূর্য’।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের আধিকারিক দিব্যেন্দু সাহা সোমবার বলছিলেন, ‘সিঁদুর গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ‘বিক্সা ওরেলানা’। মধ্য আমেরিকাতে এই গাছ দেখা যায়। এখান আমাদের রাজ্যেও বহু জায়গায় দেখা যাচ্ছে। এই গাছের বীজের রং টকটকে লাল। সিঁদুরের মতোই। তা ব্যবহার করলে কোনওরকম ক্ষতি হয় না। এছাড়া খাবার রং করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। শরীরে ক্ষতি হয় না। পরীক্ষা করে তা দেখা গিয়েছে। গাছটি বহু বছর বাঁচে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের খামারেও গাছটি চাষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
কৃষি দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েক বছর আগে ফুলিয়ায় এই গাছ দেখা যায়। তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় ফুলিয়া কৃষি খামার পরিদর্শনে গিয়ে গাছটি দেখে অবাক হয়ে যান। এই গাছটি বিভিন্ন জায়গায় যাতে চাষ করা যায় তা নিয়ে সেই সময় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। দুর্গাপুরের বাসিন্দা দীপালি দত্ত বলেন, ‘আমাদের নার্সারিতে গাছটি এনেছিলাম। এটি সিদুঁর বা লিপস্টিক গাছ নামেও পরিচিত। বীজ ভাঙলেই সিঁদুরের মতো লাল রং বেরিয়ে আসে। গাছটির চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে।’ জেলা কৃষি দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, এই গাছের বীজে শুধু রূপচর্চার রসদ লুকিয়ে নেই, অনেক ভেষজ গুণও রয়েছে। ব্যবসায়িক ভাবে এই গাছ চাষ করলে লাভ পাওয়া যায়। বীজ থেকে রং তৈরির জন্য কোনও রাসায়নিক ব্যবহার করার দরকার হয় না। বীজ ভাঙলেই সিদুঁরের মতো রং হয়। বিভিন্ন ধরণের সস বা মিষ্টি রং করতেও এই গাছের বীজ ব্যবহার করা যেতে পারে। এখন অনেক নার্সারিতে এই গাছ পওয়া যাচ্ছে। গাছ রোপণ করার আট থেকে ১০ মাসের মধ্যে বীজ তৈরি হয়। বর্তমানে বাজারি সিঁদুরে রাসায়নিক থাকে। তা থেকে অ্যালার্জি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু, সিঁদুর গাছের বীজ থেকে উৎপন্ন সিঁদুরে কোনও সমস্যা হবে না বলেই মত বিশেষজ্ঞদের।
তাই, অচিরেই হয়তো বাংলাজুড়ে রাসায়নিক সিঁদুরের বিরুদ্ধে গর্জে উঠবে ‘অপারেশন সিঁদুর’! আশায় কৃষিদপ্তর। নিজস্ব চিত্র