ঈশান বন্দ্যোপাধ্যায়
'টেরা কোটা জানেন না? বাংলার এক বড় সম্পদ!'
'ট্যাড়া কোঠা? মানে, ব্যাঁকা বাড়ি?'
কেউ কোনও বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করলে ফেলুদার স্কুলমাস্টার মূর্তিটা বেরিয়ে পড়ে। ও বলল, 'টেরা– টি ই আর আর এ–ল্যাটিন ও ইটালিয়ান কথা, মানে মাটি; আর কোটা–সি ও ডবল টি এ–এও ইটালিয়ান কথা, মানে পোড়া। মাটি আর বালি মিশিয়ে তা দিয়ে নানা রকম মূর্তি ইত্যাদি করে উনুনের আঁচে রেখে দিলে যে লাল চেহারাটা নেয় তাকে বলে টেরা কোটা। যেমন সাধারণ ইট। যেটা বানানো হয় সেটা যে শুধু দেখতে সুন্দর তা নয়, টেকসইও বটে। এই টেরাকোটার মন্দির ছড়িয়ে আছে সারা পশ্চিমবাংলায় আর বাংলাদেশে। তার মধ্যে সেরা মন্দির কিছু পাওয়া যাবে বীরভূমে। বাংলার এ সম্পদ সম্বন্ধে যে ওয়াকিবহাল নয় সে বাংলার কিছুই জানে না।'
এ গল্প আমরা সবাই ছোটবেলায় পড়েছি, রবার্টসনের রুবি। গল্পের শুরুতেই টেরাকোটা বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করে জটায়ু ফেলুদার কাছে ধাতানি খাচ্ছেন বটে, কিন্তু আমরাই বা কতটা গভীরে গিয়ে জানতে চেয়েছি টেরাকোটার বিষয়ে? ভাবতে অবাক লাগে, টেরাকোটার কাজ, অর্থাৎ মাটিকে পুড়িয়ে তাকে লালচে রং দিয়ে তা দিয়ে নানা রকম জিনিসপত্র ও মূর্তি বানানো, মানব সভ্যতার একদম আদিকাল থেকেই চলে আসছে। পৃথিবীর যে যে জায়গাগুলোতে প্রথম মানব সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল, অর্থাৎ প্রাচীন ইজিপ্ট, গ্রিস, চিন এবং অবশ্যই ভারতবর্ষ, সব জায়গাতেই টেরাকোটার কাজের প্রচলন ছিল।
ঠিক কীভাবে তৈরি করা হয় টেরাকোটা? আগুনে পোড়ানোর আগে পটারস হুইল বা স্লিপ কাস্টিং-এর মাধ্যমে মাটিকে রূপ দেওয়া হয়। তারপর আগুনের চুল্লি বানিয়ে নানা রকম দাহ্যপদার্থ দিয়ে ঢেকে ৬০০ থেকে ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ব্যবহার করে তৈরি হয় টেরাকোটা। এই উষ্ণতায় আয়রন অক্সাইড-এর সঙ্গে অক্সিজেনের বিক্রিয়া চলে এবং তার ফলেই লালচে রংটি পাওয়া যায়। যদিও অবস্থাভেদে হলুদ, কমলা, গোলাপি, বাদামি ইত্যাদি নানারকম রংও পাওয়া যেতে পারে। পোড়ানো হয়ে গেলে কিছু ক্ষেত্রে খোদাই করে নানা আকৃতি তৈরি করা হয়। খোদাই করে টেরাকোটার কাজ করার পদ্ধতি বাকি পৃথিবীতে খুব একটা প্রচলিত নয়, কিন্তু বাংলার নানা মন্দির এবং মসজিদে এই ধরনের কাজের বহু নিদর্শন পাওয়া যায়।
টেরাকোটার ইতিহাস বহু প্রাচীন। হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর খননকার্য চলবার সময় প্রত্নতাত্ত্বিকরা টেরাকোটার তৈরি মাতৃমূর্তি পেয়েছেন। এর থেকেই বোঝা যায় যে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগেও মানুষ টেরাকোটার কাজ জানতো। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া থেকে পাওয়া 'বার্নে রিলিফ' টেরাকোটা আর্টের একটি পৃথিবীবিখ্যাত নিদর্শন। প্রাচীন মিশরে মৃতদেহ সমাধিস্থ করবার সময় এক ধরনের ছোট পুতুলও সমাধিস্থ করা হতো, যে পুতুলকে বলা হতো 'শাবতি' বা 'উশাবতি'। প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, এই পুতুলগুলি মৃত ব্যক্তির অনুচর হিসেবে কাজ করবে। এই পুতুলগুলিও বহুক্ষেত্রে টেরাকোটার হতো। চিন দেশের ভাস্কর্যে টেরাকোটাকে বহু ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। চিনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াং-এর মৃত্যুর পর তাঁর সৈন্যবাহিনীর টেরাকোটার প্রতিরূপ বানিয়ে তাঁর সঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। এটি 'টেরাকোটা আর্মি' নামে বিখ্যাত। প্রাচীন গ্রেকো-রোমান ভাস্কর্যের ইতিহাসেও টেরাকোটার তৈরি বহু মূর্তি পাওয়া যায়।
আমাদের দেশে টেরাকোটার ইতিহাস হরপ্পা সভ্যতা থেকে শুরু হলেও তা কখনওই প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। মৌর্য বংশের শাসনকালে টেরাকোটা দিয়ে মাতৃমূর্তি তৈরি হত। দক্ষিণের সাতবাহন সাম্রাজ্যে টেরাকোটার মূর্তি তৈরি হতো এক অনন্য উপায়ে, মূর্তির সামনের এবং পেছনের অংশের জন্য আলাদা ছাঁচ বানিয়ে আলাদাভাবে তৈরি করে তারপর জোড়া হত, ফলে মূর্তিগুলো ফাঁপা হত। এই পদ্ধতি সম্ভবত রোমানদের থেকে শেখা। এই বিশেষ পদ্ধতিতে টেরাকোটার কাজ এদেশে অন্য কোথাও দেখা যায় না। আধুনিক যুগে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং ছত্তিশগড়ের বস্তার অঞ্চলে এখনও টেরাকোটার কাজ চলে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার কাজ বিশেষভাবে খ্যাতিসম্পন্ন। বিষ্ণুপুরের বহু মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার অসামান্য কাজ দেখতে পাওয়া যায়। টেরাকোটার তৈরি বাঁকুড়ার ঘোড়াও খুব বিখ্যাত, 'বেঙ্গল স্কুল অফ টেরাকোটা'-র একটি অনন্য অবদান এই টেরাকোটার ঘোড়া।
টেরাকোটা শিল্পের ইতিহাস ধরে রাখার জন্য ভারত সরকারের পক্ষ থেকে নয়াদিল্লিতে 'সংস্কৃতি মিউজিয়াম অফ ইন্ডিয়ান টেরাকোটা' প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০১০ সালে ইন্ডিয়া পোস্ট সার্ভিস টেরাকোটা শিল্পকে মর্যাদা দিতে একটি নতুন পোস্টাল স্ট্যাম্প-ও বের করেছিল।
আত্মবিস্মৃতির এই যুগে বাংলা তথা ভারতের টেরাকোটার এই অনন্য ইতিহাস আমাদের সকলের মনে রাখা ও রক্ষা করা প্রয়োজন। না হলে, ফেলুদার বকাবকি কপালে আছেই, নিশ্চিত!