শীতল চক্রবর্তী, বালুরঘাট
দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে শহিদ প্রফুল্ল চাকির নাতনি মাধবি তালুকদারের অর্ধাহারে দিন কাটছে। শতবর্ষ ছুঁই ছুুঁই এই বৃদ্ধা পিডাবলুডির জায়গায় একটি ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে কোনওরকমে মাথা গুঁজে পড়ে রয়েছেন। সঙ্গে রয়েছে এক বিশেষ ভাবে সক্ষম–সহ দুই ছেলে। ওই ছেলে সামান্য চায়ের দোকান চালান। তাতেও সংসার চলে না।
অপরের সাহায্যে খাওয়া জুটছে তাঁদের। ‘অপারেশন সিঁদুর’–এর পর যখন গোটা দেশে দেশভক্তির জোয়ার বইছে, তখন গঙ্গারামপুর থানার পাশে ক্ষুদিরামের সঙ্গে এক ব্র্যাকেটে উচ্চারিত হওয়া প্রফুল্ল চাকির উত্তরসূরিদের এই অবস্থা আমাদের মাথা নত করে দেয়।
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর থানার পাশেই মাধবী তালুকদারের কুঁড়ে ঘর। তাঁর মায়ের ছোট কাকা ছিলেন প্রফুল্ল চাকি। এ হেন বিপ্লবীর নাতনির নেই কোনও শৌচাগার। শৌচকর্ম করতে ভরসা প্রতিবেশীদের বাড়ি। মেলেনি সরকারি ঘর। মেলে না কোনও ভাতাও। দু’বেলা অন্ন জোটানোই চ্যালেঞ্জ তাঁর। ২৯ বছর ধরে এই ঘরেই বসবাস করছেন মাধবী।
ক্ষুদিরামের সহযোগীর প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলেন, ‘আমার মায়ের ছোট কাকা ছিলেন তিনি। আমার মায়ের বাবার (দাদুর) নাম প্রতাপ চাকি। তাঁর ভাই প্রফুল্ল চাকি।’ দেখেছেন কখনও, এই প্রশ্নের উত্তরে মাধবী বলেন, ‘খুব ছোটবেলায়। বিহারের আচরাই বগুড়া জেলায়। মাটির বাড়িতে তিনি থাকতেন। দেশ স্বাধীনের জন্য তাঁর অবদান কম নয়।’
এই বয়সেও ক্ষুদিরাম বসুর পুলিশের হাতে ধরা পড়া, প্রফুল্ল চাকির ট্রেন থেকে পুলিশকে লাথি মেরে ফেলে দিয়ে পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করা, সবই গড়গড় করে বলে যেতে পারেন। ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর পূর্ববঙ্গে মামাদের বাড়িতেই বড় হন মাধবী। মামা মারা যাওয়ার পর থেকেই তাঁর অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়।
দেশভাগের পর চলে আসেন গঙ্গারামপুরে। তারপর স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে এই লড়াই শুরু। তাঁর আক্ষেপ, ‘সরকার থেকে কিছুই পেলাম না। পিডাবলুডি জায়গার উপরে ভাঙা কুঁড়ে ঘরে কোনওক্রমে টিকে রয়েছি। তার উপর এক ছেলে বিশেষ ভাবে সক্ষম। ছেলেও কিছু সাহায্য পায় না। ভরসা বলতে আরেক ছেলের চায়ের দোকান।’
বিশেষ ভাবে সক্ষম ছেলে বলেন, ‘সরকার আমাদের দিকে একটু মুখ তুললেই বেঁচে যেতাম। কিন্তু সেটা হল কোথায়?’ মাধবীদের এক প্রতিবেশী মিলন মজুমদার বলেন, ‘যাঁদের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তাঁদের পরিবারের এক সদস্যের এমন দশা, সত্যিই দুঃখের। সরকারকে বিষয়টি দেখার অনুরোধ করছি।’
গঙ্গারামপুর পুরসভা ভাইস চেয়ারম্যান জয়ন্তকুমার দাস বলেন, ‘ওঁদের অবস্থার কথা জানি। শীঘ্রই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গঙ্গারামপুরের মহকুমাশাসক অভিষেক শুক্লা বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।’ এ মাসের দু’তারিখেই মৃত্যু দিন গিয়েছে প্রফুল্ল চাকির। সেই দিনটি আর আলাদা ভাবে পালন করেন না মাধবী। কিন্তু ১৫ অগস্ট এই অশক্ত শরীর নিয়েও কাছের কোনও স্বাধীনতা দিবস পালনের অনুষ্ঠানে হাজির হন। জাতীয় পতাকাকে স্যালুট জানান। প্রফুল্ল চাকির রক্ত যে তাঁর শরীরে।