• মুর্শিদাবাদ দিয়ে শুরু, পহেলগাঁও কাণ্ডের পর সিপিএমকে আরও আক্রমণে শুভেন্দু, ‘প্রান্তিক শক্তি’ বামেরা কেন অধিকারীর লক্ষ্য
    আনন্দবাজার | ১৪ মে ২০২৫
  • মুর্শিদাবাদের হিংসায় নিহত হরগোবিন্দ দাস এবং চন্দন দাসকে তাদের কর্মী বলে দাবি করেছিল সিপিএম। পরিস্থিতি তপ্ত থাকতেই নিহত পিতা-পুত্রের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে শমসেরগঞ্জে ছুটেছিলেন রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, যুবনেত্রী মিনাক্ষী মুখোপাধ্যায়রা। ওই পর্বেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী নিহত দু’জনের ‘বাম’ পরিচয়কে সরিয়ে ‘হিন্দু’ পরিচয়কে বড় করে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘ওঁরা হিন্দু বলেই ওঁদের মেরে ফেলা হয়েছে।’’ বস্তুত, সিপিএমের হেফাজত থেকে নিজেদের দিকে দাস পরিবারকে নিয়েও ফেলেছেন শুভেন্দুরা।

    গত ২০ এপ্রিল ব্রিগেডে সমাবেশ করেছিল সিপিএমের শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর এবং বস্তি সংগঠন। সেই সভায় ‘জনবিস্ফোরণ’ না হলেও ভিড় মন্দ ছিল না। কিন্তু ব্রিগেডের অব্যবহিত পরে শুভেন্দু তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘মাঠ ফাঁকা ছিল। আমি ধন্যবাদ জানাব, হিন্দুরা ওই সভায় যাননি।’’

    পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পরবর্তী সময়ে বামেদের বিরুদ্ধে আক্রমণকে আরও জোরালো করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। রাজ্য সিপিএমের প্রভাতী মুখপত্রের নাম করে বলেছেন, ‘‘ওই কাগজ কেউ পড়ে না। ঝালমুড়ির ঠোঙা হিসাবেও ব্যবহৃত হয় না। পোষ্যের বিষ্ঠা পরিষ্কার করতে কাজে লাগে।’’ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমালোচক বামেদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়ে শুভেন্দু বলেছেন, ‘‘২০২৬ সালের পর যাদবপুর থেকে দেশবিরোধী শক্তিকে চুলের মুঠি ধরে পেটাতে পেটাতে বার করে এনে ড্রোনে বেঁধে পাকিস্তানে ফেলে আসা হবে।’’

    গত কয়েকটি নির্বাচনে বামেরা বিধানসভা এবং লোকসভায় (বাংলা থেকে) শুধু শূন্য নয়, ভোট শতাংশের নিরিখেও ‘প্রান্তিক শক্তি’তে পরিণত হয়েছে। কৌতূহলের বিষয় হল, এ হেন বামেদের কেন শুভেন্দু ধারাবাহিক আক্রমণ করছেন?

    বাম এবং বিজেপির নেতারা একান্ত আলোচনায় যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তা প্রায় অভিন্ন। সিপিএম নেতৃত্বের ব্যাখ্যার সঙ্গে মিশে থাকছে ‘আশঙ্কা’। বিজেপির ক্ষেত্রে সেটাই ‘আশা’। সিপিএমের প্রথম সারির নেতাদের বক্তব্য, শুভেন্দু তাঁর রাজনীতিতে অবিচল থাকতে চান। বামেদের দিকে এখনও যে হিন্দু ভোট রয়েছে, তাকেও বিজেপিমুখী করতে চান শুভেন্দু। বিজেপির নেতাদেরও বক্তব্য, বামেদের বাক্সে থাকা হিন্দু ভোট টানতে পারলে বাংলার অনেক আসনে সমীকরণ পাল্টে যাবে। বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘যে লোক সিপিএমের ব্রিগেডে গিয়েছিল, সেই গ্রামীণ জনতার ৭০ শতাংশই ভোট দেবেন বিজেপিকে। কারণ, তৃণমূলকে হারাতে পারবে বিজেপিই।’’ আর সেলিম বলেছেন, ‘‘বিজেপি হিন্দু-হিন্দু ভাই-ভাই স্লোগান দিচ্ছে। শুভেন্দু হিন্দু সম্রাট হওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিজেপির ভিতরেই হিন্দুরা এক থাকতে পারছেন না। দিলীপ ঘোষেরা ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাই শুভেন্দু হতাশা থেকে বামেদের মুণ্ডপাত করছেন।’’

    গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির ভোটের ফারাক ছিল ৭ শতাংশ। বাম-কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোট ছিল ১১ শতাংশের বেশি। বিজেপির অনেকের বক্তব্য, বাম-কংগ্রেসের যে ভোট গত লোকসভাতেও ছিল, তার বৃহদংশই হিন্দুদের। সেই ভোট বিজেপির দিকে টেনে আনতে পারলে অনেক অঙ্ক বদলে যেতে পারে। আবার বামেদের আশঙ্কা, বাংলাদেশের হাওয়া স্তিমিত হতে না-হতেই যে ভাবে মুর্শিদাবাদ এবং পহেলগাঁও কাণ্ড ঘটেছে, তা বিজেপির মাটিতেই সার-জল দিয়েছে। ভারত-পাক সংঘাতের আবহে বামেরা যখন ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নামছে, তখন সমর্থকদের অনেকেই দলের অবস্থানকে সমাজমাধ্যমে সমালোচনায় বিদ্ধ করছেন। যা বামেদের আরও শঙ্কিত করছে। আশা জাগাচ্ছে বিজেপির মধ্যে।

    ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন থেকেই বামেদের ভোট বিজেপির বাক্সে যাওয়া শুরু হয়েছিল। মাঝে পঞ্চায়েত ভোটে বেশ কিছু এলাকায় বাম ভোট ফিরলেও বড় নির্বাচনে তার পরিবর্তন হয়নি। যার ফলে বঙ্গ রাজনীতিতে ‘দ্বিমেরু বাস্তুতন্ত্র’ তৈরি হয়ে গিয়েছে। এক দিকে তৃণমূল, অন্য দিকে বিজেপি। পদ্মশিবিরের অনেক নেতা একান্ত আলোচনায় মানছেন, বাম-কংগ্রেসের ভোট যে যে জেলায় উল্লেখযোগ্য ভাবে পূঞ্জীভূত, তার মধ্যে রয়েছে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, মালদহ, উত্তর দিনাজপুর, হুগলি। ঘটনাচক্রে, এই সব জেলাতেই গত কয়েক বছরে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটেছে। ফলে প্রেক্ষাপট প্রস্তুত। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ তাকে আরও দৃঢ় করেছে বলেই অভিমত তাঁদের অনেকের। আবার বামেরা পেশাদারদের সাহায্য নিয়ে ২০২৬-এর লক্ষ্যে যে যে জেলায় কিছু আসনে বিশেষ নজর দিয়ে শূন্যের গেরো কাটানোর কর্মসূচি নিয়েছে, সেই তালিকাতেও রয়েছে এই জেলাগুলিই। যা নিয়ে সম্প্রতি বাগুইআটিতে প্রশিক্ষণ শিবিরও করেছে সিপিএম।

    হিন্দু ভোটের মেরুকরণ যে বিজেপির একমাত্র লক্ষ্য, এ বিষয়ে পদ্মশিবিরের কোনও লুকোছাপা নেই। আবার বিজেপির এ-ও ব্যাখ্যা যে, বামেদের দিকে থাকা হিন্দু ভোট তাঁদের দিকে টানা অনেক বেশি সহজ। কারণ, সেই ভোটারদের মধ্যে তৃণমূল-বিরোধিতা মৌলিক সূচক। এখন তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপিই। তৃণমূলের দিকে যে হিন্দু ভোট রয়েছে, তা কতটা পদ্মশিবিরে আসবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, বিজেপির অনেকেই মনে করেন, যে হিন্দুরা তৃণমূলের পক্ষে, তাঁরা হয় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রশ্নে জোড়াফুলকে বাছছেন, না-হয় রুটিরুজির জন্য ভোট দিচ্ছেন। তাতে ধস নামানো এখনই মুশকিল। যদিও দক্ষিণবঙ্গের এক প্রবীণ বিজেপি নেতার কথায়, ‘‘হিন্দুত্বের প্রচারকে এই মাত্রায় রাখতে পারলে তৃণমূলের সমর্থনেও থাবা বসানো সম্ভব। কারণ, ভোটের বাকি আরও এক বছর।’’

    কিন্তু সে সবই খাতা এবং মাথার পাটিগণিত। বাস্তবের ভোট রাজনীতি যে ভিন্ন, তা বিজেপির অভিজ্ঞতার মধ্যেও রয়েছে। ২০১৯ সালের ভোটে এক লাফে অনেকটা এগোনোর পরে ২০২১ এবং ২০২৪-এর ভোটে ‘ধাক্কা’ খেয়েছে পদ্মশিবির। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের অশ্বমেধের ঘোড়া থমকে গিয়েছে বাংলার সীমান্তে। আবার এ-ও ঠিক যে, ২০২১ বা ২০২৪ সালের ভোটে বিজেপির হিন্দুত্বের প্রচার থাকলেও বাংলাদেশ, মুর্শিদাবাদ, পহেলগাঁওয়ের মতো প্রেক্ষাপটের ‘অনুঘটক’ ছিল না। বর্তমান পরিস্থিতিতে বামেদের দিকে শুভেন্দুর ধারাবাহিক আক্রমণ সে দিক থেকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)