• ‘পরিবর্তনের’ ১৪ বছর! নজির গড়ে মমতার তিন মেয়াদে তিন বার পাল্টেছে বিরোধী দল, কেন বাংলায় বারবার ‘চলো পাল্টাই’
    আনন্দবাজার | ১৪ মে ২০২৫
  • ভোট হয় সরকার গড়ার জন্য। বা ভাঙার জন্য। কিন্তু বাংলায় গত তিনটি বিধানসভা ভোটের ফল বলছে, রাজ্যের মানুষ শুধু সরকার গড়ার জন্য ভোট দেননি। পাশাপাশি ভোট দিয়েছেন বিরোধী দলের বদল ঘটাতেও। যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে নতুন নজির সৃষ্টি করেছে বাংলার রাজনীতিতে।

    ২০১১ সালের ১৩ মে ছিল বিধানসভা ভোটের ফলপ্রকাশ। যে ভোটে ধসে পড়েছিল ৩৪ বছরের বাম শাসন। তার পর কেটে গিয়েছে ১৪ বছর। গঙ্গা, শিলাবতী, মাতলা, তিস্তা দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল। কিন্তু এই ১৪ বছরে শাসক হিসাবে মমতা বার বার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেও তাঁর বিরোধী শিবির বারংবার বদলে গিয়েছে। মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদে প্রধান বিরোধী দল ছিল বামেরা। বিরোধী দলনেতা ছিলেন সূর্যকান্ত মিশ্র। দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে উঠে আসে কংগ্রেস। আসন সংখ্যার নিরিখে বামেরা চলে যায় তৃতীয় স্থানে। ২০১৬-২০২১ বিরোধী দলনেতা ছিলেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান। আবার ২০২১-এর ভোটে বাংলার বিধানসভায় বাম-কংগ্রেস শূন্য হয়ে যায়। প্রধান বিরোধী দল হিসাবে মাথা তোলে বিজেপি। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী।

    বামেদের ক্ষমতা থেকে সরাতে মমতার স্লোগান ছিল ‘পরিবর্তন চাই’ এবং ‘চলো পাল্টাই’। কিন্তু দেখা গেল তার পর থেকে সরকার থাকা দলের বদল না-ঘটলেও পাল্টে পাল্টে গিয়েছে বিরোধী শিবির। কেন এই প্রবণতা?

    তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের যুক্তি, ‘‘এক দিকে জনমুখী কাজের জন্য মমতাদির প্রতি মানুষের সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছে। আর বিরোধীরা সাফল্য না-পাওয়ায় বিরোধী ভোটারেরা বিভ্রান্ত হয়ে শিবির বদল করেছেন। মোদ্দা কথা, বিরোধীদের কারও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।’’ এই প্রসঙ্গেই কুণাল মনে করিয়ে দিয়েছেন, ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ভেঙে মমতা তৃণমূল তৈরি করার পরের বছরই নির্বাচনী সাফল্য পেয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারে শরিকও হয়েছিলেন। রেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্বও পেয়েছিলেন। যা মানুষের কাছে ‘বিকল্প’ হিসাবে বিশ্বাসযোগ্য ছিল। কিন্তু বাকিরা কেউ তা পারেনি। বাংলার প্রেক্ষাপটে বিরোধী অবস্থায় থেকে সাফল্য দেখাতে পারেনি।

    সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের আবার ব্যাখ্যা, ‘‘বামফ্রন্ট সরকার পতনের পরে হিলারি ক্লিন্টন বাংলায় এসে বলেছিলেন, এখানে সরকার বদল হয়নি, জমানা (রেজিম) বদল হয়েছে। তার ফলে এখানে রাজনীতির মূল্যবোধ যে যে ভিতের উপর দাঁড়িয়ে ছিল, সেই পারস্পরিক সম্পর্ক, সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি— সবগুলিই দুমড়েমুচড়ে দেওয়া হয়েছে। সমাজের মধ্যে নিচুতলায় যে ভাবে মূল্যবোধের ভাঙন চলেছে, তা-ই প্রতিফলিত হচ্ছে বিধানসভায়।’’ কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ‘‘বাম-কংগ্রেস দুর্বল হয়েছে বলেই বিজেপি বৃদ্ধি পেয়েছে। বামেদের বা কংগ্রেসকে দুর্বল করার লক্ষ্যেই মমতা এগিয়েছিলেন। কারণ, বিজেপির কাছে মমতা বা মমতার কাছে বিজেপি কোনও বিপদ নয়। বরং স্বাভাবিক মিত্র (ন্যাচারাল অ্যালাই)। তা-ই এই বদল।’’

    মমতার তৃতীয় মেয়াদে প্রধান বিরোধীদল হয়ে উঠে-আসা বিজেপির সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের অবশ্য বক্তব্য, ‘‘বাংলায় এর আগে যারা বিরোধী ছিল, তারা নিজেদের মতাদর্শ এবং কর্মসূচির সঙ্গে আপস করেছিল। মানুষ বিশ্বাস করেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপিকে বেছে নিয়েছেন।’’ তবে শমীক পাশাপাশিই মনে করিয়ে দিতে চাইছেন, সার্বিক ভাবে বাংলার রাজনীতির ‘অবনমন’ ঘটেছে। তাঁর কথায়, ‘‘বাংলার রাজনীতি দীন হয়েছে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিতে তর্কের একটা পরিবেশ ছিল। এখন সেটা নেই।’’

    তবে প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা মান্নান কোনও কারণ ব্যাখ্যার মধ্যে যাননি। তাঁর কথায়, ‘‘মানুষ রায় দিচ্ছেন বলেই বিরোধী দল বদলাচ্ছে। গণতন্ত্রে মানুষের রায়টাই তো আসল।’’

    পঞ্চাশের দশক থেকে রাজ্য বিধানসভায় সিপিআইয়ের তরফে বিরোধী দলনেতা ছিলেন জ্যোতি বসু। তার পর ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯ সালের যুক্তফ্রন্টের সময়ে কংগ্রেসের তরফে বিরোধী দলনেতা ছিলেন যথাক্রমে খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত এবং সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। ১৯৭১-এর নির্বাচনের পরেও জ্যোতিবাবু বিরোধী দলনেতা হয়েছিলেন। কিন্তু তখন তিনি সিপিএমে। কমিউনিস্ট পার্টি তত দিনে ভাগ হয়ে গিয়েছে। ১৯৭২-’৭৭ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর। বিরোধী দলনেতা ছিলেন সিপিআইয়ের বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৯৭৭ থেকে টানা ৩৪ বছর বামেদের সরকার ছিল বাংলায়। জ্যোতিবাবুর প্রথম সরকারের সময়ে কোনও দলের কেউই আসন সংখ্যার নিরিখে বিরোধী দলনেতার মর্যাদা পাননি। ফলে বিরোধী দলনেতা ছিলেন না। কিন্তু তার পরে ২০০১ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের নেতারাই ছিলেন বিরোধী দলনেতা। সেই তালিকায় নাম রয়েছে আব্দুস সাত্তার, জয়নাল আবেদিন, অতীশ সিংহদের। ২০০১ এবং ২০০৬-এর ভোটে বিরোধী দল হিসাবে উঠে আসে তৃণমূল। বিরোধী দলনেতা ছিলেন পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায়।

    ২০১১ সালে মমতার ক্ষমতায় আসার নির্বাচনে তৃণমূলের জোট ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে। সেই সময়ে প্রধান বিরোধীদল ছিল বামেরা। আবার সেই কংগ্রেসই ২০১৬ সালে বামেদের সঙ্গে জোট করেছিল। সেই জোটের ফলে প্রধান বিরোধীদল হিসাবে উত্থান হয়েছিল কংগ্রেসের। তার পরে সেই পরিসর নিয়ে নেয় বিজেপি। একান্ত আলোচনায় অনেক নেতার ব্যাখ্যা, এই বদলে নির্দিষ্ট একটি নকশা রয়েছে। তা হল, বাংলায় যে বাম বাস্তুতন্ত্র (লেফ্‌ট ইকোসিস্টেম) ছিল, তা থেকে ক্রমশ দক্ষিণপন্থার দিকে সরণ হয়েছে মৌলিক রাজনীতির। যে কারণে বাম থেকে কংগ্রেস হয়ে বিজেপির দিকে সরেছে বিরোধী ভোট। এবং প্রায় সব শিবিরের নেতারাই মানছেন, এই পরিমণ্ডল এখন জারি থাকবে। তাতে অনুঘটকের কাজ করছে জাতীয় রাজনীতির ‘আবহাওয়া’ও।

    সব ঠিকঠাক চললে আগামী বছর এই সময়ে বাংলায় বিধানসভার ভোটপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। সেখানেও কি শাসক একই থেকে বদলে যাবে বিরোধী পরিসর? না কি নতুন কোনও খাতে বইবে বঙ্গ রাজনীতি?
  • Link to this news (আনন্দবাজার)