• বাজির ভয়ে মগডালেই প্রসব, বন দপ্তরের ভূমিকায় ক্ষোভ
    এই সময় | ১৪ মে ২০২৫
  • কেরালা, হিমাচল প্রদেশ, এ রাজ্যের মালবাজার, ঝাড়গ্রাম— বন্যপ্রাণের উপরে অত্যাচারের তালিকাটা ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সেই তালিকায় নবতম সংযোজন পূর্ব মেদিনীপুরের মাইশোরা।

    প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছিল একটি হনুমান। সেই সময়ে স্থানীয় কয়েকজন হনুমানটির গায়ে শব্দবাজি ছুড়ে দেয়। বিকট আওয়াজে ভয় পেয়ে হনুমানটি একটি গাছের মগডালে উঠে পড়ে। সেখানেই তিন সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু তিনটি ছানাই গাছ থেকে পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যায়। গুরুতর জখম মা হনুমানটি রহিমা বিবি নামে স্থানীয় এক বাসিন্দার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। রহিমা, তাঁর ছেলে রহমত, তাঁদের পড়শি শেখ আক্তার আলিরা আপাতত হনুমানটিকে আগলে রেখেছেন।

    এই ঘটনায় বন দপ্তরের উপরে ক্ষুব্ধ এলাকার লোকজন। তাঁদের অভিযোগ, সোমবার থেকে জখম অবস্থায় হনুমানটি রহিমা বিবির বাড়িতে আছে। বন দপ্তরকে বহু বার ফোন করা হয়েছে। কিন্তু ফোনে কাউকেই পাওয়া যায়নি। মঙ্গলবার রাতে পূর্ব মেদিনীপুরের বনাধিকারিক দীপককুমার মণ্ডলের প্রতিক্রিয়া, 'বিষয়টি জানতাম না। পাঁশকুড়ার রেঞ্জ অফিসারকে বলছি, হনুমানটিকে উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে।'

    কিন্তু ফোনে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? বনাধিকারিকের সংক্ষিপ্ত জবাব, 'আসলে অনেকেরই ফোন নম্বর বদলে গিয়েছে। সেই কারণেই হয়ত এমনটা হয়েছে।'মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত পুলিশের কাছে এ বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ জানাননি। তবে ঘটনাটি শোনার পরে পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সৌম্যদীপ ভট্টাচার্য বেজায় ক্ষুব্ধ।

    তিনি বলেন, 'অত্যন্ত অমানবিক ঘটনা। বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি। প্রয়োজনে সুয়োমোটো মামলা করে পদক্ষেপ করা হবে।' প্রতি বছর আমের মরশুমে হনুমানের দল আসে মাইশোরা এলাকায়। এ বারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শনিবার ওই ঘটনার পরে জখম হনুমানটি সোমবারে রহিমা বিবির বাড়িতে আশ্রয় নেয়।

    রহিমা জানান, হনুমানটির পায়েও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে। জিতেন সিং নামে এক ব্যক্তি স্থানীয় চিকিৎসকের কাছ থেকে কিছু ওষুধপত্র নিয়ে এসেছেন। শেখ আক্তার আলির পরিবারের লোকজনও হনুমানটির যত্ন নিচ্ছেন। দু'বেলা হনুমানটিকে বিস্কুট, ফল ইত্যাদি খেতে দেওয়া হচ্ছে। তবে রহিমা ও তাঁর পড়শিরা চাইছেন, বন দপ্তর হনুমানটিকে উদ্ধার করে নিয়ে গিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।

    রহিমার কথায়, 'মানুষের বিবেক বলে কি আর কিছুই নেই গো? প্রসব যন্ত্রণায় অবলা জীবটি কাতরাচ্ছিল। তখনই কয়েকজন তার গায়ে শব্দবাজি ছুড়ে দেয়। ভয়ে-যন্ত্রণায় বেচারি মগডালে আশ্রয় নেয়। সেখানেই তিনটি বাচ্চার জন্ম দেয়, কিন্তু সবগুলোই গাছ থেকে পড়ে মারা গিয়েছে।'

    এই ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে কেরলের মালাপ্পুরম জেলার সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি। বছর পাঁচেক আগে একটি অন্তঃসত্ত্বা হাতিকে বাজিভরা আনারস খেতে দেওয়া হয়েছিল। আর সেই বাজি ভরা আনারস ফাটতেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় হাতিটির জিভ এবং মুখ। তবুও সন্তান যাতে বাঁচে, সেই প্রাণ চলে যাওয়া অবস্থাতেও হাতিটি দাঁড়িয়েছিল জলের মধ্যে। কিন্তু হাতি ও তার সন্তান কেউই বাঁচেনি।

    বনবিভাগের আধিকারিক মোহন কৃষ্ণন সেই ঘটনার পরে লিখেছিলেন, 'মানুষকে বিশ্বাস করাই হাতিটির কাল হলো। প্রচন্ড যন্ত্রণা আর কষ্টেও হাতিটি কারও ক্ষতি করেনি।'

    মেদিনীপুর শহরের পশুপ্রেমী দেবরাজ চক্রবর্তীও মোহন কৃষ্ণনের সুরেই বলছেন, বনের পশুপাখি সচরাচর অকারণে কারও কোনও ক্ষতি করে না। অথচ মানুষের মধ্যে সাংঘাতিক কোনও ঘটনা ঘটলে আমরা দিব্যি 'পাশবিক' বিশেষণটি ব্যবহার করি। কিন্তু ওই অন্তঃসত্ত্বা হনুমানটির সঙ্গে যা করা হলো, এটা কোন ধরনের মানবিক কাজ?'

    দেবরাজের সংযোজন, 'ঝাড়গ্রামে জ্বলন্ত শলাকা ছুড়ে একটি হাতিকে মেরে ফেলা হয়েছিল। এ বারে হনুমানটি তো জখম হলোই, তার তিনটি ছানাকেও খুন করা হলো। বন দপ্তর ও পুলিশ প্রশাসনের উচিত, অবিলম্বে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। আগামীতে বণ্যপ্রাণের উপরে অত্যাচার করার আগে মানুষ দু'বার ভাবে।' রহিমার ছেলে রহমত আলি বলছেন, 'হনুমানটি খুব কষ্ট পাচ্ছে। পায়ে দগদগে ঘা। খাবার দিচ্ছি। চিকিৎসা দরকার। বন দপ্তর সে ব্যবস্থা করলে ভালো হয়।'

  • Link to this news (এই সময়)