• ‘শিগগিরই ফিরছি’, ভিডিয়ো কলে স্ত্রীকে দেখেই কান্না পূর্ণমের
    এই সময় | ১৫ মে ২০২৫
  • প্রদীপ চক্রবর্তী, রিষড়া

    এতদিনের জমে থাকা উৎকণ্ঠা নেমে এল গাল বেয়ে। কথা বলবেন কী? কেবল কেঁদেই গেলেন। তারই মাঝে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কয়েকটা জরুরি প্রশ্ন।

    আর কি কখনও দেখা হবে প্রিয়তমা স্ত্রী রজনীর সঙ্গে? প্রাণাধিক প্রিয় ছেলে, আট বছরের আরবকে বুকে শক্ত করে চেপে ধরার ইচ্ছেটা কি অধরাই থেকে যাবে? যে নতুন সন্তান আসছে সংসারে, তার মুখ কি দেখা হলো না? এই ঘোর সংঘাতের আবহে, শত্রুদেশের সেনার ঘেরাটোপে বসে ভাবনাগুলো বোধহয় বুকের মধ্যে চেপে বসেছিল পূর্ণমের।

    এই প্রশ্নগুলোকে সঙ্গী করে পাকিস্তানের মাটিতে দাঁতে দাঁত চিপে শুধু প্রহর গুণে যাওয়াই ছিল বিএসএফ জওয়ান পূর্ণম সাউয়ের ভবিতব্য। এক, দুই দিন নয়। দীর্ঘ ২১ দিন ধরে মৃত্যুর ঘ্রাণ গায়ে নিয়ে মানসিক লড়াই চালানোর পরে বুধবার সকালে যখন ছাড়া পেলেন, তখন সকাল ন’টা। হুগলির রিষড়ার বাড়িতে খবরটা আসে তখনই।

    এতদিনে অকেজো পূর্ণমের নিজের মোবাইল। বিএসএফ থেকে রজনীকে বলা হয়, পরে ফোন আসবে। কখন? আর যেন অপেক্ষা সইছে না। তারপর থেকে চাতক পাখির মতো ফোনের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন রজনী। এদিক–সেদিক থেকে দু–একটা ফোন এলে তাড়াতাড়ি কেটে দিচ্ছিলেন। পাছে, আসল ফোনটা মিস হয়ে যায়! দুপুর বারোটা নাগাদ জ্বলে ওঠে মোবাইলের স্ক্রিন। অচেনা নম্বর। ভিডিয়ো কল। বুকের মধ্যে অজস্র দামামা বেজে ওঠে অন্তঃসত্ত্বা রজনীর।

    কল কানেক্ট করে, স্ক্রিনে পূর্ণমকে দেখে হাপুস নয়নে রজনী তখন কাঁদছেন। পূর্ণম বলেন, ‘আমি মুক্ত হয়ে দেশে ফিরেছি। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? আমার ছেলে কেমন আছে। চিন্তা কোরো না, আমি খুব শিগগির ফিরে আসব।’

    এটুকুই স্বাভাবিক গলায় বলতে পেরেছিলেন। তার পরেই স্বর ভারী হয়ে আসে তাঁর। যে কান্নাটা এতদিন বুকে চেপে বসেছিল, রজনীকে ভিডিয়ো কলে দেখে সেটাই উপচে ওঠে। অঝোরে কাঁদতে থাকেন পূর্ণম। পাশে বসে পরিবারের বাকি সদস্যরাও তখন কেঁদে আকুল। একটু পরে চোখের জল মুছে পূর্ণম রজনীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমার শরীর কেমন আছে?’ রজনী বলেন, ‘আমি ভালো আছি।’ জানতে চান, ছেলে আরব কেমন আছে?

    মায়ের পাশেই ছিল আরব। বাবার একমুখ দাড়ি দেখে প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও আড়ষ্টতা কাটিয়ে আরব বলে, ‘তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসো। আমাদের কিছু ভালো লাগছে না।’ ছেলেকে আশ্বস্ত করে পূর্ণম বলেন, ‘আমি মেডিক্যাল করিয়েই বাড়ি ফিরে আসব। তোমরা কোনও চিন্তা কোরো না।’ ছেলের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকেই বাবা–মায়ের খোঁজ নেন পূর্ণম। রজনী জানান, বাবা–মা সবাই ভালো আছেন। শেষে পূর্ণম বলেন, ‘আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নিই। পরে আবার ফোন করব।’

    আরবকে এ দিন কখনও আইসক্রিম হাতে, কখনও চকোলেট খেতে দেখা গিয়েছে। বাড়ির সামনের রাস্তায় বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবলও খেলেছে। ছোট্ট আরব জানিয়েছে, বাবার জন্য খুব মন খারাপ হতো। বাবার ছবি নিয়ে সারাক্ষণ বসে থাকত। বলে, ‘মা সবসময় কাঁদত। আমার মনেও খুব কষ্ট হতো।’

    অনেকেই জানতে চান — তাঁর সঙ্গে কী রকম ব্যবহার করেছে পাক সেনা? কী অবস্থায় ছিলেন, তাঁকে মারধর করা হতো কি না, ঠিক মতো খেতে দিত কি না, তা নিয়ে অনেকের মনেই কৌতূহল রয়েছে। রজনী জানিয়েছেন, এই বিষয়ে তাঁদের মধ্যে কোনও কথা হয়নি। এমনকী, ঠিক কবে তিনি বাড়ি ফিরবেন, সে ব্যাপারেও তাঁদের কিছু জানানো হয়নি।

    দৃশ্যতই খুশি রজনী এ দিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘মোদীজি হ্যায় তো সবকুছ মুমকিন হ্যায়। এটা আমাদের মানতেই হবে। আমার সিঁথির সিঁদুর মোদীজি রক্ষা করেছেন। আমাদের মুখ্যমন্ত্রীও খুব সাপোর্ট করেছেন। তিন দিন পর পর তিনি আমাকে আমাকে ফোন করার পরে চতুর্থ দিন আমার স্বামী ফিরে এলেন। দিদির এই সাপোর্ট কোনও দিন ভুলব না। সব থেকে বড় কথা, মুখ্যমন্ত্রী আমার স্বামীকে ভাই বলে সম্বোধন করেছেন। স্বামী রিষড়ার বাড়িতে ফিরলে মুখ্যমন্ত্রী আসবেন বলেছেন।’

    বাড়ির সামনে তখন মিডিয়ার ভিড়। সেখান থেকেই ছিটকে এসেছিল প্রশ্নটা — পূর্ণম আর কি সীমান্তে যাবেন? চোয়াল শক্ত হয় জওয়ানের স্ত্রীর। মুখ ঘুরিয়ে বলেন, ‘কেন যাবে না! আলবৎ যাবে। আবার যাবে। ওর কাজ দেশের সীমান্ত রক্ষা করা। সেটা তো করতে হবে।’

  • Link to this news (এই সময়)