সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য
থেকে জঙ্গলাকীর্ণ সুবিশাল কাশীজোড়া পরগনা জায়গির পেয়েছিলেন গঙ্গানারায়ণ সিংহ। তিনি গড়-বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন পাঁশকুড়ার চাঁপাঙালি গ্রামে। ১৫৮৬ সালে তিনি প্রয়াত হওয়ার পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র যামিনীভানু মোঘল সম্রাট আকবরের কাছ থেকে রায় উপাধি এবং রাজা খেতাব লাভ করে পাঁশকুড়ার বাহারগ্রামে নিজের নামে একটি সুবিশাল দিঘি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নাম রাখেন যানুদিঘি।
বর্তমানে নাম জানাদিঘি। এরপর ১৬২৮ সালে রাজা হন প্রতাপনারায়ণ রায়। তিনি নিজের নামে প্রতাপপুর (পাঁশকুড়া থানা) এবং হরশঙ্কর গড়কিল্লা (তমলুক থানা) নামে দু'টি গ্রাম পত্তন করেন। হরশঙ্করে তিন স্তরের পরিখা ঘেরা রাজবাড়ি তৈরি করে সেখানে কালে খাঁ ও ফাতে খাঁ নামে দু’টি কামান স্থাপন করেন।
তাঁর আমলে মহিষাদল পরগনায় জলাভাব দেখা দেওয়ায় মহিষাদলের রাজা কল্যান রায় কাঁসাই নদীর গড়পুরুষোত্তমপুর থেকে একটি খাল কেটে ক্ষীরাই খাল ছুঁয়ে হলদি নদীতে কাঁসাইয়ের প্রবাহ এনে ফেলেন। এটি বর্তমানে নতুন কাঁসাই নামে পরিচিত।
প্রতাপ নারায়ণেরর পরে ১৬৬০ সালে রাজা হন হরিনারায়ণ রায়। হরিনারায়ণের পরে ১৬৬৯ সালে লক্ষ্মীনারায়ণ রায় এবং ১৬৯২ সালে দর্পনারায়ণ রায় রাজা হলেও সময়মতো বাংলার সুবেদারকে রাজস্ব জমা না দিতে পারার জন্য ইসলামধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ১৭২০ সালে দর্পনারায়ণ রায় প্রয়াত হন।
রাজা হন জিতনারায়ণ রায়। তিনিও বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁকে সময়মতো রাজস্ব দিতে না পারায় কারারুদ্ধ হয়ে মুঙ্গেরে বন্দি হন। এক নানকপন্থী ফকিরের কেরামতিতে তিনি মুক্তি পেয়ে পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে করে ধন্য হয়ে চাঁচিয়াড়া গ্রামে (পাঁশকুড়া থানা) ১৭৩০ সালে জগন্নাথের মন্দির ও রথের প্রচলন করেন। একইসঙ্গে সেই ফকিরের স্মরনে ফকিরগঞ্জ গ্রাম ও জিতসাগর দিঘির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৭৪৪ সালে পরবর্তী রাজা হন নরনারায়ণ রায়। তিনি দেড়িয়াচক গ্রামে (কোলাঘাট থানা) গোবর্ধনধারী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। এই ঠাকুরের বিচি কলার মহোৎসব আজ সর্বজনবিদিত। ১৭৫৬ সালে পরবর্তী রাজা হন রাজনারায়ন রায়।
তিনি নিজের নামে রাজবল্লভপুর নামে একটি গ্রামের পত্তন করে গ্রামের একস্থানে রঘুনাথজিউ মন্দির মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। রাঘুনাথজিউর নাম অনুসারে রাজা রাজনারায়ণ রায় রাজবল্লভপুরের কিছুটা অংশের নামকরণ করেন রঘুনাথবাড়ি। তাঁর আনুকূল্যে খয়রা কানাইচকের (কোলাঘাট থানা) কবি নিত্যানন্দ চক্রবর্তী রচনা করেন শীতলা মঙ্গল কাব্য। এবং কিশোরচকের কবি দয়ারাম দাস রচনা করেন সারদামঙ্গল কাব্য।
১৭৭০ সালে সুন্দরনারায়ণ রায় রাজা হয়ে রাজবল্লভপুরের নামকরণ করেন সুন্দরনগর। তিনি সেখানে বসবাস শুরু করেন। ১৭৯১ সালে রাজা রঘুনাথজিউর স্মরণে রঘুনাথবাড়িতে বিজয়া দশমীতে রথের সূচনা করেছিলেন। তাঁর আমলে সরকারি কোষাগারে পরগনার রাজস্ব জমা না পড়াকে কেন্দ্র করে রাজা সুন্দরনারায়ণের সঙ্গে তাঁর দেওয়ান কাশীনাথ বর্মণের বিরোধ তৈরি হয়।
গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের নির্দেশে কাশীনাথ বর্মণ গ্রেপ্তার হন। কাশীনাথও আবার রাজার বিরুদ্ধে পাল্টা সুপ্রিম কোর্টে পাল্টা করলেন। সুপ্রিম কোর্ট রাজাকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়। গ্রেপ্তারি এড়াতে রাজা আত্মগোপন করেন।
এরপর সুপ্রিম কোর্ট রাজার জমিদারী 'ক্রোক' করার জন্য একজন সার্জেন্টসহ ৬০ জন সশস্ত্র রক্ষী পাঠায়। রাজা গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসয়ের কাছে অভিযোগ করেন যে সুপ্রিম কোর্টের পাঠানো রক্ষীরা রাজকর্মচারীদের মারধর করেছে। রাজবাড়ির ভিতরে ঢুকে বিগ্রহের অমর্যাদার পাশাপাশি মহিলাদের গয়নাগাটি চুরি করেছে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ারেন হেস্টিংস সুপ্রিম কোর্টের রক্ষীদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়ে দেন।
সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ওয়ারেন হেস্টিংসের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সারা ভারতে আলোড়ন তৈরি করে। এই দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নতুন আইন পাশ করতে বাধ্য হয়। নতুন আইনে ভারতে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা কমিয়ে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা বাড়ানো হয়।
যদিও শেষ পর্যন্ত কাশীজোড়া পরগনা রক্ষা করতে পারেননি রাজা সুন্দরনারায়ণ রায়। ৬০ হাজার টাকা রাজস্ব বাকির দায়ে তৎকালীন জেলা কালেক্টর সুবিশাল কাশীজোড়া পরগনাকে ১৩ ভাগে নিলাম করে দেন । অবসান ঘটে রাজমহিমার। ১৮০৬ সালে সুন্দরনারায়ণ রায় প্রয়াত হলেন। তারপর থেকে কাশীজোড়া পরগনার উত্তরাধিকারিগণ রাজতিলক ধারণ করে চললেও তাঁরা শুধুমাত্র নামেই রাজা।