উকিল বর্মন
এখনও দিনটার কথা ভাবলে শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কী কুক্ষণেই না গিয়েছিলাম কাঁটাতারের ও পারে!
দিনটা ছিল ১৬ এপ্রিল। দুপুরের দিকে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ সীমান্তে। পশ্চিম শীতলখুচি গ্রামে আমার বাড়ি। কাছেই সীমান্তের ও দিকে আমার একটু জমি রয়েছে।
বিএসএফের গেটে জওয়ানদের খাতায় নাম লিখে কাঁটাতারের ও পারে গিয়েছিলা জ়িরো খতিয়ানের জমিতে। বাংলাদেশ ভূখণ্ড লাগোয়া চার বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলাম। জমিতে জল সেচের কাজ শেষে স্ত্রীকে বলেছিলাম— বাড়ির দিকে এগোও, আমি বাঁশ কেটে ফিরছি। কিন্তু আর ফেরা আর হল না আমার।
সে দিন ভোর থেকে সীমান্তে বিএসএফ ও বাংলাদেশের পাচারকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। সেটা ঘিরে এমনিতেই গ্রাম তেতে ছিল। কিন্তু আমার সঙ্গে যে এমন ঘটনা ঘটবে, তা স্বপ্নেও ভাবিনি। জমিতে কাজ করছিলাম যখন, তখনও কিছু বুঝতে পারিনি।
চারপাশা বেশ নিরালা, ভয় পাওয়ার মতো কিছু ছিল না। বিএসএফের সঙ্গে পাচারকারীদের গন্ডগোলের খবর আমরা হামেশাই পাই যে। আর চাষবাস করা মানুষদের কে কী করবে! কিন্তু সেই সময়ে ঘটে গেল এমন ঘটনা, যা একেবারে সিনেমার মতো।
ঠিক এক মাস হয়ে গেল, এখনও সেই মুহূর্তের কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। বাংলাদেশের হাতিবান্ধার দিক থেকে একদল দুষ্কৃতী কখন যে চলে এসেছিল, সেটা বুঝতে পারিনি। এত বছর বাংলাদেশ লাগোয়া জমিতে কাজ করেছি, এদের কাউকেই কখনও দেখিনি।
একটা বাঁশ গাছের গোড়ায় কোপ মারতে যাব, তখন ছ’জন আমার কাছে এসে আমাকে জাপটে ধরল। আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। দু’জন ধরল আমার হাত আর দু’জন ধরল পা। এর পরে আমায় তুলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে ভুট্টা জমি দিয়ে নিয়ে চলে গেল বাংলাদেশের ভিতরে হাতিবান্ধা গ্রামে।
আমাকে ওরা নিয়ে গেল একটা বাড়ির উঠোনে। সারা দুপুর সেখানেই বসে রইলাম। শুধু আমাকে বলছিল, বিএসএফ আমাদের লোককে ছেড়ে দিক, আমরাও তোমাকে ছেড়ে দেব কাকা। বিএসএফ কাকে ধরেছে, আমি কী করে জানব— এ কথা বললাম ওদের।
সে দিন বিকেলের পরে বিজিবি এল ওই বাড়িতে। আমার সঙ্গে কথা বলল। আমি সব খুলে বললাম, কী ভাবে আমাকে তুলে নিয়ে এসেছে। এদের কবল থেকে আমাকে উদ্ধার করল বিজিবি। কিন্তু, তাতে কি আর রেহাই মেলে! বিজিবি বাংলাদেশ পুলিশের হাতে আমাকে তুলে দিল।
দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়ছিল। দেশের খবর পাচ্ছিলাম না। হাতিবান্ধা থানার পুলিশ আমাকে আর এক দফা নানা কথা জিজ্ঞেস করল। ওদের বোঝালাম, আমি অপরাধী নই। জমিতে চাষ করছিলাম। তখন এ পারের মানুষজন আমাকে জোর করে তুলে এনেছে, আমি নিজে বাংলাদেশে আসিনি।
পুলিশ আমাকে লালমণিরহাট আদালতে পেশ করে। আদালত সংশোধনাগারে পাঠায়। ১৭ এপ্রিল থেকে লালমণিরহাটের সংশোধনাগারে ছিলাম। সেখানে ভিতরে দু’বেলা খাবার খেতাম আর খোলা মাঠে ঘুরতাম। শুধু একটাই ভাবনা ছিল, পরিবারের সঙ্গে কি আমার আর দেখা হবে না? আমার স্ত্রী ও দুই সন্তানের কী হবে? তারা কেমন আছে?
উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় কেটেছে এ ক’টা দিন। বুধবার আমার মুক্তির খবর পেলাম। সন্ধের পরে বিজিবি আমাকে ১৫৭ ব্যাটেলিয়ানের বিএসএফের হাতে তুলে দেয়। এর পরে রাতে বাড়ি ফিরলাম। পরিবারের কাছে যে ফিরতে পারব তা ভাবিনি। প্রধানমন্ত্রী হোক বা মুখ্যমন্ত্রী, সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।