বিকাশ ভবনে লাঠিচার্জের ঘটনা প্রসঙ্গে মুখ খুললেন এডিজি দক্ষিণবঙ্গ
দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৭ মে ২০২৫
পুলিশ-শিক্ষক খণ্ডযুদ্ধে বেনজির চিত্র বিকাশভবন চত্বরে। বিকাশ ভবনের সামনে থেকে অবস্থান তুলতে পুলিশের অ্যাকশনে কারও ভাঙল ‘পা’, কারও হাতে রক্ত, কারও ছিঁড়ল জামা। পুলিশের সঙ্গে চাকরিহারা শিক্ষকদের ধস্তাধস্তিতে রণক্ষেত্রের চেহারা নিল সল্টলেকের বিকাশভবন চত্বর। বৃহস্পতিবার দিনভর বিকাশ ভবনের সামনে উত্তপ্ত পরিস্থিতির রেশ শুক্রবার সকালেও। শুক্রবার সকাল হতেই পরিস্থিতি আবার নতুন করে উত্তপ্ত হয়। এদিন সকালে পুলিশ আবার ব্যারিকেড করে দেয় রাস্তায়। তার পাশাপাশি ব্যারিকেড মজবুত করার জন্য বাঁশ দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। সেই ব্যারিকেড সরিয়ে দিয়ে বঞ্চিত শিক্ষকরা পুনরায় অবস্থানে বসেন। বিকাশ ভবনের সামনে থাকা ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেন চাকরিহারাদের একাংশ।
প্রসঙ্গত বৃহস্পতিবার রাতভর বিকাশভবনের সামনে বিক্ষোভ-অবস্থান করেছিলেন চাকরিহারারা। তাঁদের দাবি মানা না পর্যন্ত অবস্থান তুলবেন না বলেই জানান বিক্ষোভকারীরা। তবে রাত গড়াতেই পরিস্থিতি অন্য দিকে গড়ায়। রাতে পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ শুরু করে বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, পুলিশের লাঠির আঘাতে কয়েক জন চাকরিহারা আন্দোলনকারীর মাথাও ফাটে বলে দাবি করা হয়েছে। তারপরই বিক্ষোভকারীরা জানায়, তাঁরা রাতভর বিকাশ ভবনের অদূরে অবস্থান বিক্ষোভ করবেন।
সেই মতো বৃহস্পতিবারের মতো শুক্রবারও যাতে কোনও আধিকারিক বা কর্মী বিকাশ ভবনে আটকে না পড়েন, সেই কারণে বেলা ৩টের পর ছুটি ঘোষণা করা হয়। সূত্রের খবর, ৩টের মধ্যে সমস্ত কর্মীদের চলে যেতে বলা হয়েছে। বিজেপির কয়েকজন নেতা শুক্রবার চাকরিহারাদের পাশে দাঁড়াতে বিকাশ ভবনের সামনে তাঁদের অবস্থানে যান। তবে কারও হাতেই ছিল না দলীয় পতাকা বা ঝান্ডা। যেহেতু চাকরিহারারা শুক্রবারই দাবি করেন, সব রাজনৈতিক দলকেই তাঁদের আন্দোলনে স্বাগত জানানো হবে। তবে অবশ্যই দলীয় ঝান্ডা বা পতাকা ছাড়া আসতে হবে, হয়তো সেজন্যই গেরুয়া শিবিরের নেতারা ঝান্ডা ছাড়াই চাকরিহারাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ‘যোগ্য’ চাকরিহারাদের দীর্ঘ ১০ দিনের শান্তিপূর্ণ অবস্থান বৃহস্পতিবার হঠাৎই হিংসাত্মক আকার ধারণ করে। হাজার হাজার আন্দোলনকারী ব্যারিকেড ভেঙে ঢুকে পড়েন চত্বরে। পুলিশের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তাঁরা সরেননি, উলটে অবস্থান আরও জোরদার করেন। শুধু তাই নয়, সরকারি কর্মীদের অফিস থেকে বেরতে বাধা দেওয়া শুরু হয়। কেউ কেউ ফোনে জানান— ভিতরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। এক অন্তঃসত্ত্বা কর্মী অসুস্থ হয়ে পড়েন, আর এক মহিলার মা গুরুতর অসুস্থ— অসহায়ভাবে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লে তাঁর পায়ে চোট লাগে।
এই অবস্থায় পুলিশ প্রথমে কোনও বলপ্রয়োগ না করেই বারবার অনুরোধ করে, মাইকিং করে আন্দোলনকারীদের বোঝাতে থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন বাধ্য হয়েই পুলিশ ন্যূনতম শক্তি প্রয়োগ করে আটকে থাকা কর্মীদের উদ্ধার করে। পুলিশের দাবি, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শেষপর্যন্ত পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হয়। পুলিশের এই লাঠিচার্জ নিয়ে সমালোচনা হতেই মুখ খুলেছেন এডিজি দক্ষিণবঙ্গ সুপ্রতীম সরকার। তিনি জানিয়েছেন, “পুলিশ সংযমের নজির রেখেছে। যদি অ্যাকশনই নিতে হতো, তাহলে শুরুতেই গেট ভাঙার সময় করা যেত। কিন্তু সাত ঘণ্টা ধরে আমরা শুধুই বোঝানোর চেষ্টা করেছি।”
এডিজি দক্ষিণবঙ্গ আরও বলেন, “পুলিশ প্রথম থেকেই সংযত ছিল।” কেন লাঠিচার্জ করল পুলিশ, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, “১০ দিন ধরে চাকরিহারা আন্দোলনকারীরা পালা করে বিকাশ ভবনের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছিলেন। পুলিশ-প্রশাসন সহযোগিতা করেছে। তবে গতকাল পরিস্থিতি পাল্টে যায়। চাকরিহারাদের একাংশ ব্যারিকেড ভেঙে বিকাশ ভবন চত্বরে ঢোকার চেষ্টা করেন। জোরপূর্বক ভেতরে ঢোকার চেষ্টা হয়। পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিও করা হয়।” কিন্তু চাকরিহারা আন্দোলনকারীরা বিকাশ ভবনের কর্মীদের আটকালেই পরিস্থিতি পাল্টে যায় বলেই দাবি পুলিশের।
সুপ্রতীম সরকার বলেন, “বিকেল পর্যন্ত পুলিশ সংযত ছিল। কিন্তু ছুটি হওয়ার পরও প্রায় ৫০০-৬০০ জন বিকাশ ভবনে আটকে পড়েন। তাঁদের বার করার সময়ই আন্দোলনকারীরা পুলিশের উপর চড়াও হন। পরিস্থিতি সামাল দিতেই বাধ্য হয়ে বলপ্রয়োগ করা হয়েছে।” তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানান, “যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁদের অধিকার আছে। কিন্তু সরকারি কর্মীদের নিরাপদে বাড়ি ফেরারও অধিকার আছে। যখন তাঁদের জীবনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, তখন কিছুটা বলপ্রয়োগ একান্ত প্রয়োজন হয়ে ওঠে।”
ঘটনার সময় ১৯ জন পুলিশকর্মীও জখম হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। পুলিশের ধারণা, এই বিক্ষোভের পেছনে কারও মদত বা উসকানি রয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে চিহ্নিতও করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
যদিও লাঠিচার্জ প্রসঙ্গে পুলিশের দাবি নিয়ে চাকরিহারা শিক্ষকরা বলেন, আমরা কোনও বলপ্রয়োগ করিনি। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কারণে চাকরি গিয়েছে। ইচ্ছে করে কেউ এখানে আন্দোলন করছে না। এখন ওরা প্রোটোকলের কথা বলছে। তবে যখন চাকরি স্বচ্ছভাবে দেওয়ার কথা ছিল তখন এই প্রোটোকল কোথায় ছিল?
অন্যদিকে তৃণমূল নেতা তথা বিধাননগর পুরনিগমের চেয়ারম্যান সব্যসাচী দত্ত বিকাশ ভবনে ঢোকার চেষ্টা করলে উত্তেজনা আরও বাড়ে। সব্যসাচীর গাড়ির সামনে অনেকে শুয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে ধাক্কা মারা হয়েছে বলেও অভিযোগ। সেই ঘটনা প্রসঙ্গে পুলিশের দাবি, “বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তবে সব্যসাচী নিজের কাজে বিকাশ ভবনে এসেছিলেন। তখন আন্দোলনকারীরা তাঁকে আটকান।”