এই সময়: কারও মাথায় ব্যান্ডেজ, কেউ খুঁড়িয়ে চলছেন। কারও হাত বাঁধা গামছা দিয়ে। কেউ বিছানায় শুয়ে। চোখ খুলে তাকাতেও পারছেন না। শত লাঠি খেয়েও যাঁরা বাড়ি ফেরেননি, তাঁরা ২৪ ঘণ্টা পরেও রাস্তার উপরেই মাটি কামড়ে শুয়ে রয়েছেন।
জখম আন্দোলনকারীরা তবুও জোর গলায় বলছেন, পুলিশ দিয়ে লাঠি মেরে পা ভাঙা যায়, কিন্তু মনোবল ভাঙা যায় না। আর এই জখম ‘যোগ্য’ শিক্ষকদের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই বহু মানুষ, দল, সংগঠন, শিক্ষক থেকে নাগরিক সমাজের মানুষেরা এগিয়ে এসেছেন পাশে দাঁড়াতে।
কেউ নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে মিছিল–মিটিং করলেন দিনভর, কেউ সরাসরি চলে এলেন বিকাশ ভবনের সামনে। প্রত্যেকের একই বক্তব্য, ‘যাঁদের হাতে দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার ভার, সেই শিক্ষক–শিক্ষিকাদের পথে বসিয়ে এ কেমন আচরণ প্রশাসনের? এত রক্ত, এত লাঠি কেন?’
লাঠির ঘায়ে গুরুতর আহত হয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসিন্দা রজত হালদার। তিনি রায়দিঘির সুভাষ নগর হাইস্কুলের ফিজ়িক্যাল সায়েন্সের টিচার। চাকরি হারিয়ে রাস্তার আন্দোলনেই ছিলেন বরাবর। এর আগে কসবার ডিআই অফিস অভিযানেও পুলিশ তাঁকে মারধর করে বলে অভিযোগ। সেই কালশিটে এখনও পায়ে এবং হাতে রয়েছে।
পুরোনো ব্যথা ভোলার আগে ফের বৃহস্পতিবার পুলিশের লাঠি এসে পড়ে তাঁর মাথায়। চোখের উপরে তিনটি সেলাই নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটছে রজতের। চোখটা ঠিক থাকবে তো? চিকিৎসকরা তাঁকে জানিয়েছেন, রেটিনায় জল জমে গিয়েছে। নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হবে। না হলে দৃষ্টিশক্তি নিয়ে সমস্যা হতে পারে। রজত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী।
বিএড পাশ করে ২০১৬ সালে এসএসসি দিয়ে চাকরি পেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘বাড়িতে দেড় বছরের বাচ্চা, স্ত্রী, বৃদ্ধ মা–বাবা, ভাই, দিদা— সকলেই আছেন। তাঁরা কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন এই মার খাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে। ওঁরাই বলছেন, রাস্তা ছেড়ে যাবি না। হকের চাকরিটা বুঝে নিবি। বাড়ির লোকেরা অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন বলেই তো রাস্তায় রয়েছি। নাহলে আমার এত সাহস ছিল আগে ভেবে দেখিনি।’
পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের বাসিন্দা সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রক্তাক্ত পায়ের ছবিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। এমন ভাবে তাঁর পায়ে পুলিশ লাঠি মেরেছে বলে অভিযোগ যে, চপচপে রক্তে ভেসে যাওয়া সোমনাথের পা এখন আন্দোলনকারীদের অনেকেরই সামাজিক মাধ্যমের প্রোফাইল পিকচার।
বহু কষ্টে কলকাতাতেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া সোমনাথ বলছেন, ‘ভাবতে পারিনি এ ভাবে মারবে! ভেবেছিলাম আমরা শিক্ষক একটু রেহাই দেবে হয়তো।’ বছর দুয়েক আগে বিয়ে করেছেন তিনি। পুরুলিয়ার ছররা হাইস্কুলের কেমিস্ট্রির টিচার সোমনাথ কিছুদিন আগেই ওডিশার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডিও শেষ করেছেন।
ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে জনপ্রিয় এই শিক্ষকের বর্তমান হালের কথা ভেবে হতবাক তাঁর সহকর্মীরাও। ওই স্কুলের প্রিন্সিপাল দেবেন মোদক বলেন, ‘এমন ভাবে কেন মারা হলো ওকে, এর জবাব চাইতে আমরা দ্রুত ডিআই অফিসে যাচ্ছি।’
হাঁড়িয়া (এক ধরনের দেশি মদ) বিক্রি করে সংসার চালাতেন মা। তারপর দুই দাদা রোদে পুড়ে সুখা জমিতে ফসল ফলিয়ে ভাইকে পড়িয়েছেন। বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাসে মাস্টার্স করার পরে বিএড করে স্কুলে পড়াতেন দুলাল মুর্মু। ঝাড়গ্রামের দুলালের পরিবার এবং মহল্লায় তিনিই প্রথম এত দূর পড়াশোনা করে এই জায়গায় পৌঁছেছিলেন, শেষে দুর্নীতির পাঁকে পড়ে কোনও দোষ না করেও চাকরিটা চলে গিয়েছে তাঁর।
বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ দুলালের পায়ে এমন মার মেরেছে যে তিনি হাঁটা তো দূর, সোজা হয়ে বসতেও পারছেন না। রাস্তাতেই শুয়ে থাকা দুলাল বলেন, ‘আমার মা এখনও জানেন না যে আমার চাকরিটা নেই। বলতেও চাই না। মা চেয়েছিলেন আমি মিলিটারি হই। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল শিক্ষকতা করার। শাক ভাত খেয়ে, শুধু পেঁয়াজ দিয়ে ভাত খেয়েও আমার দাদারা আমাকে শিক্ষক করেছে। আমিও চাকরির পরে নিজের জন্য কিছু না করে দাদাদের জন্য বাড়ি করে দিয়েছি। এই দিন দেখার জন্য?’
এমন উদাহরণ আরও অনেক আছে। যেমন, শুভজিৎ দাস। তাঁর পায়ে এমন চোট যে পা ফেলতে পারছেন না। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের প্রাক্তনী বিএড, এমএডে ভালো ফল করে চাকরি পেয়েছিলেন। সেই চাকরি চলে যাওয়ায় ফেরতের দাবিতে রাস্তাতেই আছেন প্রথম দিন থেকে। এ নিয়ে দু’বার পুলিশের মার সইতে হচ্ছে তাঁকেও।
বাঁকুড়ার বাসিন্দা সুপ্রীতি অট্ট বিকাশ ভবনের অবরোধে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর আরও কিছু শিক্ষিকা বান্ধবীর সঙ্গে। অতর্কিতেই নেমে আসে পুলিশের লাঠি। কারও নখ উপড়ে যায়, কেউ কাঁধে চোট পান। আঘাত ছাড়াও সুপ্রীতির জামা কাপড় ছিঁড়ে যায় বলে অভিযোগ। ওই বিধ্বস্ত অবস্থাতেই তিনি কোনও রকম শেষ রাতের ট্রেনে বাঁকুড়া পৌঁছন।
বাংলার এই শিক্ষিকার কথায়, ‘তিন বছরের মেয়ে, স্বামী, প্রবীণ বাবা–মায়ের অবস্থা তো ছেড়েই দিন। আমরা তো বাচ্চাদের শেখাই বড়দের সম্মান করতে, সহবত শিখতে, যাঁরা অসুবিধেয় আছে তাঁদের সাহায্য করতে। কিন্তু এ কেমন শিক্ষা আমাদের রাজ্যের পুলিশ পেয়েছে যে, সে সবের ধার ধারেন না তাঁরা?’
এ দিকে চাকরিহারাদের উপরে পুলিশি লাঠিচার্জের প্রতিবাদে রাজ্যজুড়ে সরব হয়েছেন স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত পুলিশকর্মী, শাসক দলের নেতা এবং কর্মীদের বিরুদ্ধেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নেমেছে মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি (এসটিইএ)।
বিধাননগরের আচার্য সদন থেকে বিকাশ ভবন পর্যন্ত সমিতির শিক্ষক–শিক্ষিকারা এ দিন মিছিল করেন। পশ্চিমবঙ্গ প্রধান শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কৃষ্ণাংশু মিশ্র বলেন, ‘আন্দোলনরত চাকরিহারা শিক্ষকদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ অত্যন্ত নিন্দনীয় ও বর্বরোচিত কাজ। এই ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই।’
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ক্যাম্পাসে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও একই দাবিতে এ দিন বিকাশ ভবন চলোর ডাক দিয়েছিল। ঘটনার রাতে চিকিৎসার জন্য বিকাশ ভবনের সামনে ছুটে আসেন আরজি কর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত জুনিয়র ডাক্তাররা। অভয়া মঞ্চের তরফেও বহু প্রতিবাদী মানুষ জমায়েত করেন এ দিন। ছিলেন রাত দখল কর্মসূচির আয়োজকরাও।
বৃহস্পতিবার রাতের লাঠি চার্জের ঘটনার রেশ গিয়ে পড়েছে কলকাতা হাইকোর্টেও। চাকরিহারাদের ওপর বিধাননগর পুলিশের লাঠিচার্জ নিয়ে হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন এক চাকরিহারা শিক্ষক। মামলায় আবেদন করা হয়েছে, গোটা ঘটনায় বিধাননগরের পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করা হোক।
পাশাপাশি কার নির্দেশে পুলিশ লাঠিচার্জ করলো, সেই কৈফিয়ত চাওয়ার দাবিও উঠেছে হাইকোর্টে। মামলাকারীর বক্তব্য, এসএসসি মামলা এখনও সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। এই অবস্থায় একটা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে কি করে পুলিশ লাঠিচার্জ করলো? আগামী সপ্তাহে মামলার শুনানির সম্ভাবনা রয়েছে।