শ্রীময়ী মুখোপাধ্যায়
ইউডি অ্যাসিস্ট্যান্ট, স্যাট
দিনটা ছিল আমার মতো অনেক সরকারি কর্মীর কাছে বিভীষিকাময়। আমাদের অপরাধ ছিল একটাই, আমরা বিকাশ ভবনে কর্মরত সরকারি কর্মচারী।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে আমি অফিসে ঢুকি। তখন রাস্তায় অবস্থান বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন অনেকে। কেউ কেউ মাইকে প্রচার করেছেন। প্রায় ১২টা পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিকই ছিল। তার কিছুক্ষণ পরেই শুনলাম, আন্দোলনকারীরা সামনের গেট ভেঙে দিয়ে বিকাশ ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়েছেন।
পুলিশের সঙ্গে তাঁদের বচসা চলছে। কিছু পরে এ–ও শুনলাম, বিকাশ ভবনের ঢোকা-বেরোনোর সব গেট আন্দোলনকারীরা দখল করেছেন এবং তাঁরা হুমকি দিচ্ছেন, কাউকে বেরোতে দেওয়া হবে না।
দুপুর ১.৩০ নাগাদ অফিসের নিরাপত্তায় থাকা এক পুলিশকর্মী আমায় বলেন যে, উনি আমায় বিকাশ ভবনের বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন। সেই আশ্বাসে আমি ও আমার এক সহকর্মী একতলায় নেমে আসি। আমাদের সঙ্গে থাকা ওই পুলিশকর্মী জানান, ওঁর থেকে একটু এগিয়ে থাকতে।
কারণ আন্দোলনকারীরা পুলিশের সঙ্গে কোনও সরকারি কর্মচারীকে দেখলেই ধাক্কাধাক্কি করছেন, ‘চোর’ ‘চোর’ স্লোগান দিচ্ছেন। আমরা গেটের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখি, সেখানে জনা দশেক আন্দোলনকারী। তাঁদের কাছে অনুরোধ করি, আমি ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা! আমায় অন্তত ছেড়ে দিন। ওঁরা আমাদের ফিরে যেতে বলেন।
২.৩০ নাগাদ আবার দু’জন পুলিশকর্মী এবং কয়েকজন সহকর্মী আন্দোলনকারীদের অনুরোধ করেন, আমায় যেন যেতে দেওয়া হয়। একজন রাজিও হন। লিফট কাজ না করায় চারতলা থেকে হেঁটে নামি। কিন্তু আন্দোলনকারীদের একজন সোজা বলে বসেন, ‘কাউকে যেতে দেব না, তোরা ভেতরে পচে মর।’
বিকেল ৫টা নাগাদ পুলিশকর্মীরা ফের আমায় বের করার চেষ্টা করেন। তখনও কেউ যেতে দিতে রাজি হননি। উল্টে ওঁরা বলতে থাকেন যে, খাবার, জল কিছুই বাইরে থেকে আনতে দেওয়া হবে না।
সন্ধ্যা ৭.৩০ নাগাদ পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। আমার সহকর্মীরা আমায় সাধ্যমতো খাবার দিয়েছিলেন। তাঁদের নিজেদের খাবার না রেখেই।
রাত ৮টার পরে পর শোনা যায়, পুলিশ ফোর্স আসছে, সেই ফোর্স হয়তো আমাদের বের করতে পারবে। কিন্তু তখন আন্দোলনকারীরা প্রবল ইট বৃষ্টি শুরু করেছেন। ভয়ে জানলা বন্ধ করে বসেছিলাম। পালানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ইটের ভয়ে বাইরে যেতে পারিনি। টেনশনে আমি প্রচণ্ড অসুস্থ বোধ করতে থাকি।
রাত ৯.৩০ নাগাদ এক পুলিশকর্মী এসে আমাদের জানান, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে। তখন আমার এক কলিগ আর বেশ কয়েকজন পুলিশকর্মী এসে প্রায় ঘিরে ধরে আমায় বের করে আনেন। আমায় প্রায় দৌড়ে বেরোতে হয়েছে। সেই সময়েও অশ্রাব্য গালিগালাজ চলছিল। কোনও রকমে করুণাময়ী পৌঁছই। পুলিশের ওই দাদা ছিলেন বলেই হয়তো বেঁচে ফিরলাম।
অনুলিখন: শীর্ষেন্দু দেবনাথ