• DA মামলার খুঁটিনাটি, কী হলো কোর্টে? কী করতে হবে রাজ্যকে? জানুন
    এই সময় | ১৭ মে ২০২৫
  • এই সময়, নয়াদিল্লি ও কলকাতা: ২০২২-এর ২০ মে থেকে ২০২৫-এর ১৬ মে। তিন বছর বাদে বকেয়া ডিএ-র দাবিতে আন্দোলনরত রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা খানিকটা স্বস্তি পেলেন। আর প্রবল চাপের মুখে পড়ল রাজ্য সরকার।

    ২০২২-এর মে-তে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ মেটানোর জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডন ও বিচারপতি রবীন্দ্রনাথ সামন্তের ডিভিশন বেঞ্চ। সেই রায় কার্যকর না-করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল রাজ্য সরকার।

    এই তিন বছরে ১৮ বার এই মামলাটি শুনানির জন্য উঠলেও তা পিছিয়ে গিয়েছে। সরকারি কর্মচারীরা অবশ্য পিছু হটেননি। শুক্রবার শীর্ষ আদালতের বিচারপতি সঞ্জয় কারোল ও বিচারপতি সন্দীপ মেহতার ডিভিশন বেঞ্চও এই মামলার শুনানি শেষ করেনি।

    তবে এ দিন অন্তর্বর্তী নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট বলে দিয়েছে, ডিএ সরকারি কর্মচারীদের মৌলিক অধিকার। এবং পঞ্চম বেতন কমিশনের আওতায় থাকা রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ-র ২৫ শতাংশ তিন মাসের মধ্যে মিটিয়ে দিতে হবে রাজ্যকে।

    অর্থাৎ ১ এপ্রিল, ২০০৬ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫ পর্যন্ত সময়কালে বকেয়া মহার্ঘ ভাতার ২৫ শতাংশ দিতে হবে সরকারকে। রাজ্য এই টাকা মেটানোর জন্য কী পদক্ষেপ করছে, তা হলফনামা দিয়ে চার সপ্তাহের মধ্যে জানাতে হবে শীর্ষ আদালতে। আইনজ্ঞদের ব্যাখ্যা, ২০১৫-এর ৩১ ডিসেম্বরের পর থেকে এখনও পর্যন্ত বকেয়া ডিএ-র কী হবে, তা আগামী দিনে সুপ্রিম-শুনানিতে চূড়ান্ত হবে।

    সুপ্রিম কোর্টের অন্তর্বর্তী নির্দেশ পালন করতে গেলেই রাজ্যকে ১০ হাজার ৪৪২ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে বলে আদালতে জানান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে বর্ষীয়ান কৌঁসুলি অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি ও আইনজীবী হুজ়েফা আহমেদি। তাঁরা যুক্তি দেন, এই টাকা দিতে হলে রাজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে।

    যদিও আদালত তার অবস্থান থেকে সরেনি। আইনজ্ঞদের একাংশের ব্যাখ্যা, সর্বোচ্চ আদালত মনে করেছে যে, রাজ্যের যথেষ্ট ফান্ড রয়েছে এবং এই বকেয়া মেটানোটা বিরাট বোঝা হিসেবে দেখা উচিত নয়।

    হাইকোর্টের বিচারপতি ট্যান্ডন ও বিচারপতি সামন্তের রায়েই বলা হয়েছিল, ডিএ হলো রাজ্য সরকারি কর্মীদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টেও তীব্র সওয়াল করেছিল রাজ্য সরকার। সিঙ্ঘভির যুক্তি ছিল, ডিএ কোনও ভাবেই রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মৌলিক বা সাংবিধানিক অধিকার হতে পারে না।

    আইনজ্ঞদের সিংহভাগের বক্তব্য, শুক্রবার যে অন্তর্বর্তী রায় দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত, তাতেই প্রমাণ হয়েছে, ডিএ রাজ্য সরকারি কর্মীদের ন্যায্য প্রাপ্য এবং মৌলিক অধিকার। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি সরকারি কর্মচারীরা। তবে আগামী দিনে রাজ্য এ নিয়ে কী পদক্ষেপ করবে, নিয়ে কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছেন নবান্নের কর্তারা।

    তাঁদের বক্তব্য, রায়ের কপি হাতে না পেলে কিছু বলা সম্ভব নয়৷ তবে আইনজ্ঞদের ব্যাখ্যা, যে হেতু সুপ্রিম কোর্ট মামলাটির শুনানি করবে এবং তারা চূড়ান্ত রায় দেয়নি, তাই এখনই ‘রিভিউ’ বা ‘মডিফিকেশন’ অ্যাপ্লিকেশন করার সুযোগ নেই রাজ্য সরকারের।

    তাত্‍পর্যপূর্ণ হল, বুধবার ডিএ মামলার সংক্ষিপ্ত শুনানিতেই বিচারপতি কারোল বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা মূল মামলার নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত রাজ্য সরকারি কর্মীদের বকেয়া ডিএ-র ৫০ শতাংশ দিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী। এ দিনের শুনানি পর্বের শুরুতেই এ কথা মনে করিয়ে দেন তিনি। সিঙ্ঘভি বলেন, ‘এটা রাজ্যের জন্য বিরাট বোঝা হয়ে যাবে। ব্যাক ব্রেকিং। মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে রাজ্যের৷ এটা অসম্ভব৷’ এই যুক্তি গ্রহণ করেনি সুপ্রিম কোর্ট।

    বিচারপতি কারোল বলেন, ‘এই মামলার আগের সব ক’টি রায় খুঁটিয়ে দেখেছি আমরা, স্যাটের অর্ডারও দেখেছি। সব ক্ষেত্রেই ডিএ দেওয়ার পক্ষেই রায় দেওয়া হয়েছে।’ কিঞ্চিৎ উষ্মার সুরে বিচারপতি কারোল বলেন, ‘আপনারা কী চাইছেন? আমরা কি মামলা এখনই খারিজ করে দেবো চূড়ান্ত রায় দেবো?’ বিচারপতি মেহতা বলেন, ‘যে সরকারি কর্মীরা চাকরিতে আছেন, তাঁদের সঙ্গে এই আচরণ করা যায় না, এই ভাবে ডিএ বকেয়া রাখা যায় না।’

    রাজ্যের আইনজীবী আহমেদি যুক্তি দেন, ‘আমরা ডিএ দিয়েছি আগেও। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের সমান হারে ডিএ দেওয়া হয়নি। এটা সম্ভবও নয়৷ এটা রাজ্যের জন্য বিরাট বোঝা হয়ে যাবে।’ বিচারপতি সঞ্জয় কারোল তখন বলেন, ‘মোট বকেয়ার ওয়ান ফোর্থ টাকা এখনই দিয়ে দিন, আমরা অগস্টে পরবর্তী শুনানি রাখছি।’ ফের সিঙ্ঘভি ও আহমেদি জানান, এই ভাবে ডিএ দিতে হলে রাজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে। রাজ্য চালানো সম্ভব হবে না যদিও এই আবেদনে সাড়া দেয়নি শীর্ষ আদালত।

    নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকে বিচারপতি কারোল বলেন, ‘অন্তত ২৫ শতাংশ বকেয়া ডিএ দিতেই হবে রাজ্যকে। মামলার নিষ্পত্তি হলে বাকিটা পরে দেখা যাবে।’ শুনানির একেবারে শেষ পর্যায়ে বিচারপতি কারোল রাজ্যের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি এটা ব্যাখ্যা করতে পারেননি যে, রাজ্য সরকার কেন কেন্দ্রীয় সরকারের মতো বছরে দু’বার তাদের কর্মীদের ডিএ দেয়নি।’

    বর্তমানে রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা ১৮ শতাংশ ডিএ পান৷ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের বর্তমান ডিএ-র হার ৫৫ শতাংশ। গত আর্থিক বছরে রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ-র হার ছিল ১৪ শতাংশ। ১ এপ্রিল থেকে চার শতাংশ ডিএ বাড়ানো হয়। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীরা কেন্দ্রীয় হারে ডিএ না-পেলেও বাংলার হয়ে ভিন রাজ্যে ডিউটিতে গেলে কেন্দ্রীয় হারেই ডিএ পেয়ে থাকেন।

    এই বৈষম্য নিয়েও সরকারি কর্মচারীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, ২০০৯ সালের রোপা (রিভিশন অফ পে অ্যান্ড অ্যালাউন্স) রুল মেনে অল ইন্ডিয়া কর্মাশিয়াল প্রাইস ইনডেক্সের ভিত্তিতে ডিএ নির্ধারিত হোক৷ তাঁদের দাবি, এই মৌলিক দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট এ দিন কার্যত সিলমোহর দিয়েছে।

  • Link to this news (এই সময়)