তথ্যের ‘ঘাটতি’ থেকেই কি এমন পরিস্থিতি পুলিশি নিয়ন্ত্রণের বাইরে
আনন্দবাজার | ১৭ মে ২০২৫
মাসখানেক আগে কসবার ঘটনায় ঠিক যে প্রশ্ন উঠেছিল, বৃহস্পতিবার বিকাশ ভবনের সামনের ঘটনাতেও ফের সেই একই প্রশ্ন সামনে এল। পুলিশের কাছে কি আদৌ জমায়েত সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য ছিল? উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে যে পারদর্শিতা প্রয়োজন, তা-ও কি ওই সন্ধ্যায় পুলিশকে প্রয়োগ করতে দেখা গিয়েছিল? পুলিশ বাহিনীর একাংশ অবশ্য মনে করছে, তথ্যের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু সেই তথ্যকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
বিকাশ ভবন চত্বরে বৃহস্পতিবারের ঘটনা নিয়ে শুক্রবার ভবানী ভবনে সাংবাদিক বৈঠক করে রাজ্য পুলিশের কর্তারা যদিও দাবি করেছেন, সমস্ত বন্দোবস্ত রাখার পাশাপাশি পুলিশ সংযত থেকেছে দিনভর। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, বৃহস্পতিবার বিকাশ ভবনের সামনের গেটের কাছে কয়েকটি গার্ডরেল বসানো ছাড়া তেমন কিছুই করা হয়নি। পিছনের দিকের গেটে কয়েক জন মাত্র পুলিশকর্মী ছিলেন। সে দিকেই এক সময়ে উত্তেজনা ছড়ালেও পুলিশকে কোনও পদক্ষেপ করতে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ। প্রত্যক্ষদর্শীদের আরও দাবি, বিকাশ ভবনের লোহার গেট ভেঙে পড়ার পরেও বাড়তি পুলিশকর্মী মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হয়নি। ওই সময়ে পুলিশকে কার্যত দর্শকের ভূমিকাই পালন করতে দেখা গিয়েছে। উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সে ভাবে মাইকে ঘোষণা করতেও শোনা যায়নি বলে অভিযোগ।
ভবানী ভবনে রাজ্য পুলিশের এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার যদিও এ দিন দাবি করেছেন, ‘‘পুলিশ দর্শক বা অসহায়, কোনওটাই ছিল না। প্রথমে পুলিশ সংযম দেখিয়েছে। তার পরে যা প্রয়োজন, করা হয়েছে।’’ বিধাননগর পুলিশের তরফে দাবি করা হয়েছে, তিনশো থেকে চারশো পুলিশকর্মী মোতায়েন ছিলেন বিকাশ ভবন চত্বরে। ঘোষিত কর্মসূচি বলে খবর ছিল না, এমনটাও নয়। যদিও প্রাক্তন পুলিশকর্তা সলিল ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘ভুলে গেলে চলবে না, এই আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষিকারা খাতায়-কলমে এখনও সরকারি কর্মী। তাঁদের এ ভাবে পুলিশ মারছে, এটা অভাবনীয়। যদি সত্যিই ইন্টেলিজেন্স ইনপুট থেকে থাকে, তা হলে অন্তত পাঁচ-ছ’টি ধাপে ব্যারিকেড করা হয়নি কেন? দুপুরে গেট ভেঙে পড়ার পরেই কেন বাড়তি পুলিশ আনিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি? যা করছে করতে দাও, পরে শিক্ষা দেওয়া হবে— এমনটা ভেবেই কি চুপ করে থাকা হয়েছে?’’ আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায় আবার বললেন, ‘‘পুলিশ ম্যানুয়াল অনুযায়ী, কয়েক ধাপে ব্যারিকেড করার পরে প্রয়োজনে জলকামান এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার কথা। রাতের ঘটনা বলে কাঁদানে গ্যাস ছোড়া থেকে যদি বিরত থাকা হয়, তবু মানা যায়। জলকামানের ব্যবহার না করে এ ভাবে লাঠি হাতে বলপ্রয়োগ করা হবে কেন? ন্যূনতম বলপ্রয়োগ করলে আঘাত এমন গুরুতর হয়?’’
অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন, এটা বুঝে নিচুতলার পুলিশকর্মীদের উপরে লাঠিচার্জের ভার ছেড়ে না দিয়ে কেন ডিসি বা অন্তত অফিসার পদমর্যাদার পুলিশকর্মীরা সামলালেন না? আইনজীবী দেবকুমার চন্দ্র আবার বললেন, ‘‘বিধাননগর পুলিশ স্পেশাল ব্রাঞ্চের থেকে ইন্টেলিজেন্স ইনপুট পায়। স্পেশাল ব্রাঞ্চকে সাহায্য করে ইন্টেলিজেন্স বুরো। ফলে, এমন ভিড় যে হতে পারে বা পরিস্থিতি জটিল হতে পারে, এই খবর ছিল না, এটা ধরে নেওয়া মুশকিল। তা হলে প্রশ্ন ওঠে, শিক্ষা দেওয়ার মনোভাব থেকেই কি আগাম খবর থাকলেও কাজ অন্য ভাবে করা হয়েছে?’’ তাঁর প্রশ্ন, দিনের শুরুতে নেতার অনুগামীরা লোকজন সরিয়ে নেতার গাড়ির পথ তৈরি করে দিলেন। হেলমেট দিয়ে মারধর করা হল আন্দোলনকারীদের। সেই সময় থেকেই তো পুলিশের সক্রিয় হওয়ার কথা। কোথাও কারও গাড়ি আটকে পড়লে কি তিনি পাড়ার লোক ডেকে পথ করে নেন? নাকি পুলিশে জানান?
অনেকেই তুলছেন বছর দুয়েক আগের টেট আন্দোলনে অরুণিমা পাল নামে এক আন্দোলনকারীকে পুলিশের কামড়ে দেওয়ার ঘটনার কথা। অরুণিমাকেই তার পরে জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। যদিও আদালত কালক্ষেপ না করে অরুণিমাকে জামিন দেয়। আইনজীবীদের অনেকেরই প্রশ্ন, ভিড় সামলাতে না-পারার দায় এড়াতেই কি কামড় বসানো থেকে লাঠি বা লাথি মারার সব কাজকেই পুলিশের তরফে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাওয়া হচ্ছে? প্রশ্ন উঠেছে, বার বার এমন ঘটনা ঘটানো পুলিশের কি যথাযথ প্রশিক্ষণ হচ্ছে না? প্রশ্ন অনেক। যদিও প্রশাসনিক স্তর থেকে কোনওটিরই উত্তর মিলছে না।