• শিক্ষক-কাণ্ডে বাম প্রতিবাদে এ বার বিজেপির ‘গোলি মারো’
    আনন্দবাজার | ১৭ মে ২০২৫
  • দিনতিনেক আগে শান্তির কথা বলে ডাক দেওয়া নাগরিক মিছিলে চড়াও হওয়ার অভিযোগ উঠেছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। মৌলালির মোড়ে সেই ঘটনার পরে এ বার কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় বাম ছাত্র, যুব ও শিক্ষক সংগঠনের প্রতিবাদী সমাবেশের দিকে তেড়ে গেল বিজেপির ‘তিরঙ্গা যাত্রা’! বামেদের সভা চলছিল শিক্ষকদের উপরে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে। দেশের সেনাবাহিনীকে কুর্নিশ জানাতে পথে নামা বিজেপির কর্মী-সমর্থকেরা সেই সভাকে ঘিরেই ‘দেশদ্রোহী’, ‘পাকিস্তানের দালাল’ স্লোগান দিলেন। কুকথার সঙ্গেই ছোড়া হল জুতো। আওয়াজ উঠল ‘গোলি মারো..’! কোনও ক্রমে পরিস্থিতি সামাল দিল পুলিশ।

    বিকাশ ভবনের সামনে অবস্থানরত শিক্ষকদের উপরে বৃহস্পতিবার প্রথমে শাসক দলের বাহিনীর হামলা ও পরে রাতে পুলিশের লাঠি চালানোর প্রতিবাদে শুক্রবার দিনভর পথে নেমেছিল বিভিন্ন বিরোধী দল ও সংগঠন। তারই অঙ্গ হিসেবে কলেজ স্ট্রিটে কফি হাউজ চত্বরে সমাবেশ ছিল এসএফআই, ডিওয়াইএফআই, এবিটিএ, এবিপিটিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকর্মী সংগঠনের। পহেলগামে জঙ্গি হানার পরে পাকিস্তানকে ভারতীয় সেনার প্রত্যাঘাতকে কুর্নিশ এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানিয়ে এ দিন বিকালেই কলেজ স্ট্রিট থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত ‘তিরঙ্গা যাত্রা’র কর্মসূচি ছিল বিজেপির। কলেজ স্কোয়ার থেকে সেই যাত্রা শুরু হতেই বাম ছাত্র-যুবরা যে জায়গায় জড়ো হয়েছিলেন, সেখানে গিয়ে তাঁদের ‘পাকিস্তানের দালাল’, ‘দেশদ্রোহী’-সহ নানা বিশেষণ দিয়ে ক্রমাগত ‘হুমকি’ দেওয়া হয় বিজেপির মিছিল থেকে। পুলিশ দু’পক্ষের মাঝে ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। ডিওয়াইএফআইয়ের কলতান দাশগুপ্ত, কলকাতা জেলা সভাপতি সোহম মুখোপাধ্যায়, এসএফআইয়ের অর্জুন রায়েরা মানববন্ধন করে দাঁড়ান। তার পরেও মিছিল থেকে জুতো, লাঠি ছোড়া হয়। পুলিশ ক্রমাগত চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত মিছিলকে এগিয়ে দেয়।

    বিজেপির মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, শমীক ভট্টাচার্য, অগ্নিমিত্রা পাল, লকেট চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় সিংহ মাহাতো, উত্তর কলকাতা সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তমোঘ্ন ঘোষ, যুব মোর্চার রাজ্য সভাপতি ইন্দ্রনীল খাঁ প্রমুখ। তাঁরা অবশ্য অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিলেন, যখন মিছিলের একাংশ বাম জমায়েতে চড়াও হয়েছিল। ঘটনার প্রেক্ষিতে ডিওয়াইএফআই নেতা কলতান দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘‘সন্ত্রাসবাদী হামলার বিরুদ্ধে সারা দেশ একজোট। আর বিজেপি-আরএসএস চেয়েছে বিভাজন ছড়াতে। আর এ রাজ্যে আমরা একজোটে শিক্ষক নিয়োগ-দুর্নীতির প্রতিবাদ করছি। বিজেপি হতাশ। দুর্নীতিতে যুক্ত তৃণমূল নেতাই এখন বিজেপি’র বিধায়ক হয়ে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা। সে কারণে তৃণমূলের দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে তা আটকাতে মরিয়া হয়ে উঠছে বিজেপি।’’

    শ্যামবাজারে বিজেপির মিছিল শেষে দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত অবশ্য দাবি করেছেন, “আগে অনেকের জাতীয় পতাকা নিতে অসুবিধা হতো। এখন তাঁরা আমাদের অনুকরণ করে জাতীয় পতাকা নিয়ে কর্মসূচি করবেন। যদি কারও সুমতি হয়, আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। পশ্চিমবঙ্গে জাতীয়তাবাদী আবেগ তৈরি হয়েছে। আগামী দিন বাংলায় এই আবেগই থাকবে।” মহিলা মোর্চার কর্মীরা এ দিন ‘অপারেশন সিঁদুরে’র সাফল্য উদযাপন করতে নিজেদের মধ্যে সিঁদুর খেলেছেন।

    বিজেপির মিছিলের পরে বিধাননগরে শিক্ষকদের অবস্থানেও অবশ্য গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু। পুলিশের মার এবং সরকারি মদতে দুর্নীতির প্রতিবাদের পাশাপাশি সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘আপনাদের যুক্তি ন্যায়সঙ্গত। সেই পথে আপনারা এগিয়ে চলুন। যদি আমার কোনও সহযোগিতার দরকার হয়, তা হলে জানাবেন। আমি সেই চেষ্টা করব।’’ চাকরিহারা শিক্ষকদের একাংশ তাঁর কাছে আবেদন করেছেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁরা সাক্ষাৎ করতে চান। বিরোধী দলনেতা তাঁদের জানান, তিনি সাধ্যমতো চেষ্টা চালাবেন। আরএসপি-সহ বামেদের একটি প্রতিনিধিদলও শিক্ষকদের ডাকে কনভেনশনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। বিরোধী দলনেতা যাওয়ার পরে ‘জটিলতা’য় তাঁদের অবশ্য আর বক্তৃতা করতে ডাকা হয়নি।

    কলকাতার নানা জায়গায় এ দিন প্রতিবাদে নেমেছিল বিভিন্ন দল। ভবানীপুরের যদুবাবুর বাজার থেকে হাজরা মোড় পর্যন্ত ধিক্কার মিছিল ছিল প্রদেশ কংগ্রেসের। সেখান থেকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে বরখাস্ত করার দাবি তুলেছেন। মিছিল হাজরা মোড়ে পৌঁছনোর পরে কংগ্রেসের নেতৃত্ব পুলিশি ‘বর্বরতার’ প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে ব্যারিকেড করে তাঁদের আটকায় পুলিশ। কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে পুলিশের কথা কাটাকাটি হয়। এক পুলিশকর্মীকে শুভঙ্কর প্রশ্ন করেন, “আজ ব্যারিকেড ভাঙা অন্যায় হলে, গত কাল বিকাশ ভবনের সামনে পুলিশ অন্যায় করেনি?” এর পরেই শুভঙ্কর বলেছেন, “নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি, দুর্নীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী আগে তো সর্বত্র দৌড়ে যেতেন। এখন কেন জায়গা করে দিচ্ছেন বিজেপিকে? তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। অপদার্থ শিক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হোক।” শহরে প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভ-সভা করেছে এসইউসি, সিপিআই, আরএসপি-র ছাত্র সংগঠন পিএসইউ, ‘রাইট টু এডুকেশন ফোরাম’, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি-সহ নানা সংগঠন ও মঞ্চ। ‘যোগ্য’ শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীদের উপরে পুলিশি আক্রমণের প্রতিবাদে রাজ্য জুড়ে ১৯ মে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে ডিএসও।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)