• বারাণসীর ঘাটে আবার মগজাস্ত্রের খেল! কেমন হল ‘দ্য একেন: বেনারসে বিভীষিকা’?
    আনন্দবাজার | ১৭ মে ২০২৫
  • এখানে নেই অরণ্যদেব, টারজ়ান। এখানে বুদ্ধির খেল দেখায় না ক্যাপ্টেন স্পার্ক। তার পর হিজিবিজ্‌বিজ্! তবে পরিচালক জয়দীপ মুখোপাধ্যায় বড় পর্দার বারাণসী তুলে ধরলেন ঘাট-অলিগলি-লস্যি-চাট এবং ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’। ‘দ্য একেন: বেনারসে বিভীষিকা’য় ভরপুর উন্মাদনা। সদ্য মুক্তি পাওয়া গোয়েন্দা একেনের এই ছবি হলঘরে দেখতে দেখতে প্রতি পদে পদে কিশোরবেলায় দেখা 'জয় বাবা ফেলুনাথ'- এর কথা মনে পড়ে যায়। চলে আসে বারাণসীর চিরপরিচিত ছবি।

    ওটিটি-র পর্দায় আটটি সিজ়ন এবং দু’টি পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবির দৌলতে গোয়েন্দা একেন্দ্র সেন দর্শককে ইতিমধ্যে পাহাড়-মরুভূমি-সমুদ্র সব জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। গরমের ছুটিতে এ বার একেন, প্রমথ এবং বাপির সঙ্গে ঘোরার পালা বারাণসী। ফেলুদা-তোপসে-জটায়ুকে যে বারাণসী ঘাটে দেখিয়ে সত্যজিৎ রায় আমাদের মন ভুলিয়েছেন, সেই ঘাটেই একেন তার দুই সহচর নিয়ে হাজির হয়। কিন্তু বড় পর্দার একেন যেন খানিকটা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হয়ে ওঠে এই ছবিতে। তা কেবল পর্দার আকার বড় হওয়ার জন্য কি? বাঙালি লেখক সুজন দাশগুপ্তের তৈরি গোয়েন্দা চরিত্র একেনবাবু। এই রহস্যধর্মী চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার পদ্মনাভ দাশগুপ্ত। বরাবরের মতোই বাংলা ভাষা নিয়ে খেলেছেন তিনি। বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের পাশাপাশি কিছু চেনা সংলাপও চেনা চরিত্রের মুখে বসিয়েছেন পদ্মনাভ। যা দর্শকের মুখে হাসি ফোটাতে বাধ্য। কিন্তু দু’ঘণ্টার এই ছবির মধ্যে সরলতা যেন অনেকটাই কম। উগ্রপন্থা, বোমা, পুলিশের ভারে চিত্রনাট্যে কোথাও যেন অতিরিক্ত মেদ জমে উঠল। একেনসুলভ ছন্দগুলো ঠিক সুরে বেজেও উঠল না। কোথাও গিয়ে এই ছবিটি যেন শুধুই ধীরে ধীরে বড়দের হয়ে উঠল। ওটিটির সিজ়নগুলির মতো আর তেমন আট থেকে আশির হয়ে রইল না।

    ‘দ্য একেন: বেনারসে বিভীষিকা’য় মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছেন অনির্বাণ চক্রবর্তী, সুহোত্র মুখোপাধ্যায় এবং সোমক ঘোষ। এত বছর ধরে ‘একেন’ সিরিজ়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার ফলে সকলেই নিজেদের চরিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে মিশে গিয়েছেন। তাই আলাদা ভাবে তাঁদের প্রশংসা করার মতো বিশেষণও বোধ হয় বাকি নেই। এই ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ দর্শকের অতি প্রিয় এবং তেমনটাই থাকবেন। বরং এই ছবির জন্য যাঁদের অভিনয় নিয়ে আলাদা ভাবে প্রশংসা করা প্রয়োজন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। ছবিতে বহু রূপে খলনায়ক সেজেছেন এই জাত অভিনেতা। অবাঙালির মুখে হিন্দিঘেঁষা বাংলা বলে নিজেদের চরিত্রগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন ইশা সাহা এবং সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায়। দুঁদে পুলিশকর্মীর চরিত্রে সাগ্নিকের অভিনয় দুর্দান্ত। ছোট চরিত্রে অভিনয় করে নজর কেড়েছেন স্বীকৃতি মজুমদার। ছবিতে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতি কম হলেও তিনি সেই কম সময়ের মধ্যেই অভিনয়ের ছাপ রেখে গিয়েছেন। তবে গৌরব চক্রবর্তী এবং ঋষভ বসুর অভিনয় মনে তেমন দাগ কাটতে পারল না। খুব কম সময়ের মধ্যে গোয়েন্দা কাহিনির গল্প বলতে গিয়ে একটু আধটু ছন্দপতনও হয়েছে বটে। তবে দর্শক প্রাণ ভরে বারাণসী দেখবেন এই ছবিতে। হোলির দৃশ্য থেকে শুরু করে, নৌকাবিহার, ঘাটের সন্ধ্যা আরতি— প্রতিটি দৃশ্যই মনোময়।

    তবে ‘দ্য একেন: বেনারসে বিভীষিকা’র একেন ছবির অন্তিম দৃশ্যে ধীরে ধীরে যেন জটায়ু হয়ে উঠল। দেখা গেল ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ‘নাইফ থ্রোয়িং’-এর দৃশ্যের অনুষঙ্গ তৈরি দৃশ্য। কেন? বাঙালি কি ফেলুদা পেরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন কিছু তৈরি করবে না? ফেলুদার স্মৃতি আবার ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কিছুই কি তৈরি হবে না?

    ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর দুর্গা ঠাকুর তৈরির দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ঋতুপর্ণের ‘উৎসব’ ছবিতেও। বাঙালিরা কি সত্যজিৎ ঘরানার ঘেরাটোপেই বন্দি হয়ে থাকল? একেনবাবু বারাণসীতে বুদ্ধি পাকিয়ে ‘চোর’ ধরিয়ে দিল ঠিকই, কিন্তু মগজাস্ত্র নিয়ে বারাণসীর হৃদয় আগলে রাখল সেই সত্যজিৎ এবং তাঁর ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’।
  • Link to this news (আনন্দবাজার)