সমীর মণ্ডল, মেদিনীপুর
কয়েক বছর আগেও যাঁরা জানতেন না স্যানিটারি ন্যাপকিন কী, আজ তাঁরাই হয়ে উঠেছেন গ্রামের নারী স্বাস্থ্য সচেতনতার মুখ। এলাকায় তাঁরা পরিচিত ‘ন্যাপকিন দিদি’ নামে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রামগুলির একদল মহিলা নিজেরাই তৈরি করছেন স্যানিটারি ন্যাপকিন। শুধু তাই নয়, নিজেদের জীবনে বদল এনে তাঁরা এখন অন্য মহিলাদেরও সচেতন করছেন পিরিয়ড স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে। স্বনির্ভরতার পথে এই যাত্রা শুরু হয়েছে কেশপুর ব্লক প্রশাসনের উদ্যোগে।
বর্তমানে ১০ নম্বর কেশপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ‘দিশারী’, ১১ নম্বর কলাগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের ‘সম্মেলনী’ এবং ১২ নম্বর সরিষাখোলা গ্রাম পঞ্চায়েতের ‘উদিতা’— এই তিনটি সঙ্ঘের মোট ৩০ জন মহিলা প্রতিদিন শয়ে শয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করছেন। কেশপুরের মাথানিয়া এলাকায় নির্মিত ‘মার্কেট হাট’-এ চলছে এই কর্মযজ্ঞ। সকাল থেকে সন্ধে এই মহিলারা কাজ করছেন জেদ ও নিষ্ঠা নিয়ে।
এই উদ্যোগ অনেকটাই মনে করিয়ে দেয় অরুণাচলম মুরুগানান্থমের কথা, যাঁকে ‘প্যাডম্যান’ নামে সারা বিশ্ব চেনে। নিজের স্ত্রীর স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি উপলব্ধি করে তিনি তৈরি করেছিলেন স্বল্পমূল্যের স্যানিটারি ন্যাপকিন।
তাঁকে নিয়ে বলিউডে তৈরি হয়েছে সিনেমাও। ঠিক তেমনই, কেশপুরের সুষমা সাউ, মৌসুমি সাউ, শম্পা মণ্ডল, বিলকিস বিবি, বকুল মান্না, শ্রীদেবী দোলইরাও আজ হয়ে উঠেছেন তাঁদের এলাকার ‘ন্যাপকিন দিদি’। সুষমা বলেন, ‘আগে জানতামই না এ সব কী। এখন নিজেরা তৈরি করছি, আবার অন্যদেরও বলছি, পিরিয়ডস লজ্জার নয়, যত্নের বিষয়।’
প্রায় দেড় বছর আগে নদিয়ার কল্যাণী থেকে প্রথম প্রশিক্ষণ নেন তাঁরা। পরে প্রশিক্ষকরা কেশপুরে এসে হাতে-কলমে শেখান। সেই শিক্ষার ফসল আজকের এই ইউনিট।
বিডিও কৌশিস রায় বলেন, ‘মার্কেট হাটে জায়গা ও যন্ত্রপাতি দিয়ে আমরা সহযোগিতা করেছি। এই প্রোডাক্ট জেলার বিভিন্ন হাসপাতালেও সরবরাহ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ইতিমধ্যে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে।’
গ্রামে মহিলাদের মধ্যে এখনও অনেকেই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। পুরোনো কাপড়েই কাজ চালান। ফলে ইউটিআই, সারভিকাল ইনফেকশন, এমনকী, বন্ধ্যত্বের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই প্রেক্ষিতে কেশপুরের মহিলাদের এই উদ্যোগ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রতিটি সভা-সমিতিতে, যেখানে মহিলাদের উপস্থিতি বেশি, সেখানে তাঁরা বোঝানোর চেষ্টা করেন, স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে কী উপকার হয়। এক কথায়, তাঁরা এখন শুধু প্যাড প্রস্তুতকারক নন, বরং সচেতনতার দূত।
কেশপুর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি চিত্ত গোরাই বলেন, ‘প্রত্যন্ত গ্রামের মহিলাদের এই উৎসাহ অভূতপূর্ব। আমরা পঞ্চায়েত সমিতি ও ব্লকের পক্ষ থেকে সবসময়ে পাশে থাকব।’
মৌসুমি, সুষমারা বলেন, ‘ছ’মাস আগে জেলাশাসক খুরশিদ আলি কাদের স্যর–সহ প্রশাসনের অন্য আধিকারিকরা এসে এই ইউনিট উদ্বোধন করে গিয়েছেন। মাঝে মেশিন খারাপ হয়ে কিছুদিন কাজ বন্ধ ছিল, তবে এখন তা আবার পুরোদমে চালু হয়েছে।’
এই মহিলাদের হাত ধরে বদলাচ্ছে গ্রামের নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁদের প্রত্যাশা, প্রতিটি মেয়ে ও মহিলা যেন নিজেদের শরীর ও স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেন। সমাজে যে মেনস্ট্রুয়েশন এখনও ট্যাবু, কেশপুরের এই মহিলারাই প্রমাণ করছেন- সচেতনতা ও স্বনির্ভরতার মিশেলে সেটাকেও জয় করা সম্ভব। এরা শুধু ন্যাপকিন তৈরি করছেন না, বরং এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিও তৈরি করছেন, ‘স্বাস্থ্য হোক অধিকার, লজ্জা নয়।’