• বিমান-বাণেও বিদ্ধ পুলিশ, আন্দোলনকারীদের কটাক্ষ ফিরহাদের
    এই সময় | ১৮ মে ২০২৫
  • এই সময়: চাকরি ফেরত চেয়ে তাঁরা পেয়েছেন পুলিশের লাঠি, ঘুষি, লাথি। কারও পা ভেঙেছে, কারও চোখ খারাপ হতে বসেছে, কেউ হাতে ব্যান্ডেজ নিয়েও মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। শুক্রবার পুলিশ দাবি করেছে, তারা যথেষ্ট সংযম ও ধৈর্য দেখিয়েছে।

    চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলনকে তারা মানবিক ভাবেই দেখেছে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সন্ধেয় আন্দোলনকারীরা আশপাশের অফিসে কর্মরত পুরুষ–মহিলাদের আটকে রাখার ফলেই বাধ্য হয়ে পুলিশকে ‘যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকু’ বলপ্রয়োগ করতে হয়েছে।

    তবে পুলিশের এই ব্যাখ্যার পরেও প্রাক্তন পুলিশকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে, শিক্ষকদের উপরে পুলিশ কি এ ভাবে লাঠিচার্জ না–করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত না? শুক্রবার রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইন–শৃঙ্খলা) জাভেদ শামিম ও এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার সাংবাদিক বৈঠকে পুলিশ ‘মানবিক’ ছিল বলে যে দাবি করেছেন, তার সঙ্গে কি বাস্তবে পুলিশের ভূমিকা খুব সাযুজ্যপূর্ণ হলো?


    পুলিশ আরও সংবেদনশীল হতে পারত। তবে ওঁরা যে ভাবে বিকাশ ভবনের গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকেছেন, সেটাকেও আমরা সমর্থন করতে পারছি না

    বিমান বন্দোপাধ্যায়

    শনিবার পুলিশের ভূমিকা নিয়ে মুখ খুলেছেন রাজ্য বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘পুলিশ আরও একটু সংবেদনশীল হতে পারত।’ আর প্রাক্তন পুলিশকর্তাদের অনেকের মতে, বৃহস্পতিবার সকালেই যখন আন্দোলনকারীরা বিকাশ ভবনের গেট ভেঙে ভিতরে ঢুকেছিলেন, তখনই তো পুলিশ তাঁদের আটকাতে পারত।

    আগে থেকে বেশি সংখ্যায় পুলিশ মোতায়েন রেখে সেই ব্যবস্থা নিলে তো সন্ধেয় পরিস্থিতি এ রকম বেগতিক হতো না। পুলিশের ‘ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট’ নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।

    অতীতে এ রকম বহু আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া প্রাক্তন পুলিশকর্তা চয়ন মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘এই কর্মসূচির কথা তো অনেক আগে থেকেই পুলিশ জানত। তা হলে আরও বেশি ফোর্স কেন মোতায়েন করা হলো না?

    কেন এই আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে আরও ভালো করে পুলিশ আন্ডারস্ট্যান্ডিং করল না? তা হলে তো এই অপ্রীতিকর ঘটনা, লাঠিচার্জ এড়ানো যেত।’ সু্প্রতিমরা অবশ্য দাবি করেছেন, চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রতি পুলিশ মানবিক ছিল বলেই নাকি গেট ভাঙার সময়ে ‘পুলিশ সচেতন ভাবেই কিছু করেনি।’


    নেতাজি ইন্ডোরেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, যা ব্যবস্থা করার করবেন। সেই বিশ্বাসটা রাখলেই হয়ে যেত। এত গোলমালের দরকার ছিল না। বেশির ভাগ মানুষই বাড়ি চলে গিয়েছেন। যাঁরা টিভিতে মুখ দেখাতে চান, তাঁরাই এখনও বসে আছেন। এটা নাটক হচ্ছে

    ফিরহাদ হাকিম

    এক প্রবীণ পুলিশকর্তার প্রশ্ন, ‘সাংবাদিক বৈঠকে একজন এডিজি এ কথা বলার অর্থ, গেট ভাঙা বা জোর করে বিকাশ ভবনে ঢুকে পড়ার বিষয়টিকে পুলিশ মানবিক ভাবেই দেখেছে। তা হলে সেই অপরাধে পরে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, জোর করে অন্যের সম্পত্তিতে ঢুকে পড়া বা বেআইনি জমায়েতের মতো ধারায় মামলা দায়ের করল কেন? আসলে সন্ধের পরে পুলিশের লাঠিচার্জের বিষয়টাকে সামাল দিতে গিয়ে এই ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে পুলিশকর্তাদের। কিন্তু সেই ব্যাখ্যাটা যথেষ্ট নয়।’

    পুলিশ আর একটু সংবেদনশীল হতে পারত বলে জানালেও বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এ ভাবে বিকাশ ভবনের তালা ভেঙে ঢুকে পড়াকেও সমর্থন করতে পারছেন না। বিরোধীদের কটাক্ষ, এর আগে কসবার ডিআই অফিসে চাকরিহারাদের উপরে পুলিশি নির্যাতনের পরেও বেশ কিছু তৃণমূল নেতা ‘বিবেকের ভূমিকায় ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ নেমেছিলেন। কিন্তু বদলায়নি পুলিশ-প্রশাসনের নিপীড়নমূলক আচরণ।

    আন্দোলনকারীরাও কি একটু সংবেদনশীল হতে পারতেন না? এ িনয়েও প্রশ্ন রয়েছে অনেকের মধ্যে। বিশেষ করে পুলিশ দাবি করেছে, এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকেও বেরোতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। বার বার পুলিশের কাছে প্যানিক কল আসছিল। তাই বাধ্য হয়ে পুলিশকে অবশেষে বলপ্রয়োগ করতে হয়।

    যদিও এ দিন চাকরিহারা শিক্ষক নেতা চিন্ময় মণ্ডল দু’টি কল রেকর্ডিং সামনে এনে দাবি করেছেন, ‘ওই অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে আমরা দু’বার নীচে নেমে আসতে বলেছি। উনি এসেওছিলেন। কিন্তু পুলিশ আর বিকাশ ভবনের নিরাপত্তা রক্ষীরাই তাঁকে বেরোতে দেয়নি। গেট বন্ধ করে দিয়েছিল, বাইরে কাঁদানে গ্যাস চার্জ হচ্ছে বলে জানিয়েছিল।’ ওই মহিলার সঙ্গে এ দিন যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি আর কোনও মন্তব্য করেননি।

    পুলিশের ভূমিকা নিয়ে এই বিতর্কের মধ্যে রাজ্যের শাসকদলের একাধিক নেতা–মন্ত্রী অবশ্য এ দিনও বিঁধেছেন আন্দোলনকারীদেরই। কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্য, ‘নেতাজি ইন্ডোরেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, যা ব্যবস্থা করার করবেন। সেই বিশ্বাসটা রাখলেই হয়ে যেত। এত গোলমালের দরকার ছিল না। বেশির ভাগ মানুষই বাড়ি চলে গিয়েছেন। যাঁরা টিভিতে মুখ দেখাতে চান, তাঁরাই এখনও বসে আছেন। এটা নাটক হচ্ছে।’

    চাকরিহারাদের পাল্টা প্রশ্ন, যে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিকে চিহ্নিত করে সুপ্রিম কোর্ট একলপ্তে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি কেড়ে নেয়, সেই সরকারের মন্ত্রী হয়েই ফিরহাদ এই যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষগুলোর আন্দোলনকে ‘নাটক’ হিসেবে দেখছেন? চাকরিহারা শিক্ষক নেতা মেহবুব মণ্ডলের কটাক্ষ, ‘কাগজে মুড়ে টাকা নেওয়ার পরে উনিও বলেছিলেন ওটা নাটক।

    আমরা সেই নাটক টিভিতে বসে বসে দেখেছি। সেটা যদি নাটক হয়, তা হলে এটাও নাটক। আর ওঁর নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই ভাবেই আন্দোলন করে ক্ষমতায় এসেছেন। তা হলে সেই আন্দোলনগুলিকেও উনি নাটকই বলছেন তো?’

    ফিরহাদের অবশ্য ব্যাখ্যা, ‘বিকাশ ভবন ঘেরাও বৃহস্পতিবার ওরা যা করেছে, এ ভাবে মানুষের উপরে অত্যাচার করে আন্দোলন হতে পারে না। অসুস্থ বলে কেউ ওষুধ কিনতে যেতে পারবে না! অসুস্থ মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে পারবে না? বিকাশ ভবনে চাকরি করি বলে বাড়ি যেতে পারবে না!’ তাঁর সংযোজন, ‘সু্প্রিম কোর্টের রায় বিকাশ ভবন ঘেরাও করে বদল করা যাবে না।’

    আরও এক ধাপ সুর চড়িয়ে তৃণমূলের এক মুখপাত্র বিকেলে বলেন, ‘উনি (ফিরহাদ) অপ্রিয় সত্যি কথা বলে ফেলেছেন। মামলা সু্প্রিম কোর্টে হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস মতো রাজ্য এবং এসএসসি রিভিউ পিটিশন ফাইল করেছে। মুখ্যমন্ত্রী শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের রিলিফ দিয়েছেন। কিন্তু চাকরিহারারা ক্যামেরা দেখলেই ছুটে যাচ্ছেন। লেন্সের দিকে তাকিয়ে শুয়ে পড়ছেন। মিডিয়া ছবি তুলতে গেলে নিজেরাই ধাক্কাধাক্কি করছেন।’

    এই সবের মধ্যেই অবশ্য বিমানের ভিন্ন বক্তব্য সামনে এসেছে। যাকে রাজনৈতিক মহল, বিচ্ছিন্ন মন্তব্য হিসেবেই দেখছে। কারণ, তাঁদের বক্তব্য, বিমানের মতো যদি পুলিশ-প্রশাসনও ‘সংবেদনশীল’ হতো তা হলে বৃহস্পতিবার রাতে সাইরেন বাজিয়ে পুলিশ লাঠি চালাত না।

  • Link to this news (এই সময়)