• ফটো অ্যালবাম আজ শুধুই স্মৃতির পাতায়
    এই সময় | ১৮ মে ২০২৫
  • সুদীপ দত্ত

    ‘স্মৃতি হয়ে শুধু আছি, ছবি হয়ে রয়ে গেছি’। ছবিকে সযত্নে সাজিয়ে রাখত যে ‘ফোটো অ্যালবাম’ তা আজ সত্যিই স্মৃতি হয়ে গিয়েছে। সত্তরের দশকে ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রাম, সেলফি বা স্টেটাস শব্দগুলো না–থাকলেও ছবির গল্প ছিল। সেই ছবি তোলা হতো স্টুডিয়োতে। মধ্যবিত্তের ছবি তোলার ইচ্ছেপূরণ করত ‘আগফা ক্লিক -৩’ ক্যামেরা।

    সেই ক্যামেরায় ১২০ মিলিমিটার সাদাকালো ফিল্মে খান দশ–বারো ছবি তোলা যেত। তারপর স্টুডিও থেকে ‘নেগেটিভ’ প্রিন্ট করার পরে হাতে মিলত ছবি। ছবি রাখা থাকত অ্যালবামে। স্টুডিয়ো অর্থাৎ, যেখানে ছবি তোলা, ছবি প্রিন্ট করা পর্ব চলত, সেখানেই বিক্রি হতো ছবি সাজিয়ে রাখার অ্যালবাম। তার চেহারা ছিল শক্ত মলাটের আয়তাকার একটা বইয়ের মতো।

    ভিতরে থাকত কালো রঙের অমসৃণ বেশ কিছু পাতা। সেখানে দুটো ‘কর্ণারে’ আটকে দেওয়া হতো ছবি। অ্যালবামে প্রত্যেক পাতার আগে থাকত একটি অস্বচ্ছ ট্রেসিং পেপার। একটা পাতার পিছনের দিক যাতে পরের পাতার ছবির উপরে গিয়ে না পড়ে তার জন্যই ব্যবহার করা হতো এই বিশেষ কাগজ।

    অন্নপ্রাশন থেকে মৃত্যু -একদিন জীবনের বহু ছবিই ধরে রাখত এই অ্যালবাম। স্টুডিয়োয় ‘বক্স ক্যামেরা’য় তোলা সাদাকালো ছবি থেকে শুরু করে এসএলআর ক্যামেরায় ৩৫ মিলিমিটারে পোস্টকার্ড সাইজের রঙিন ছবি- কী না দেখেছে সে! এক জীবনের কত সুখ- দুঃখ, হাসি-কান্না, মিলন- বিচ্ছেদ, উজ্জ্বল–অনুজ্জ্বল মুহূর্ত - সবকিছুরই নীরব সাক্ষী ছিল এই অ্যালবাম। কালের নিয়মে আধুনিক হয়ে উঠেছিল সে।

    পুরোনো পাট চুকিয়ে তার চেহারা তখন সাধারণ বইয়ের মতো। তার ভিতরে প্লাস্টিকের পাতা। তার একটা দিক থাকত খোলা। সেখান দিয়ে পোস্টকার্ড সাইজের ছবি ঢুকিয়ে দিলেই হলো।

    বিখ্যাত ফিল্ম কোম্পানি ‘কোডাক’–এর পাশাপাশি ‘কোনিকা’ কোম্পানিও বাজারে এনেছিল এ রকম অ্যালবাম। কোচবিহারের একটি স্টুডিয়োর কর্ণধার চিন্ময় বসু বলেন, ‘তখন ছিল ফিল্মের যুগ। সাদাকালো থেকে রঙিন। সরস্বতী পুজোর দিন স্টুডিয়োয় ভিড় করত স্কুলের ছেলেমেয়েরা। ভিড় বাড়ত দুর্গাপুজোর সময়েও।

    অনেকেই তখন কর্মক্ষেত্র থেকে বাড়িতে ফিরতেন। সপরিবারে ছবি তুলতেন তাঁরা। ফোটো অ্যালবাম, ছবি সাঁটানোর ‘কর্ণার’ সবই বিক্রি করতাম। মোটামুটি ১৯৯৮ -এ ডিজিটাল ক্যামেরা আসে। তার পরেই শেষ হয়ে যায় একটা যুগ। সোনালি সেই দিনগুলো কবেই হারিয়ে গিয়েছে।’

    ফের বিবর্তন। স্মার্টফোন এসে ‘কত রঙের ছবি’ নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে। আজকের ‘ফোন গ্যালারি’তে কত ছবি যে রাখা থাকে তার ইয়ত্তা নেই। ছবি এখন শুধু স্থির নয়, চলমান এবং সবাকও। নিমেষে বদলে যায় ‘ডিপি’ আর ‘স্টেটাস’। হারিয়েও যায় নিমেষে।

    ছবিকে নিজের বুকে ধরে রাখার সেই ‘ছবিবই’ আজ আর নেই। তবুও হয়তো বাড়ির কোথাও তাকে খুঁজে পান কোনও প্রবীণ। হয়তো তার হাত ধরে পৌঁছে যান স্মৃতির দেশে। যেখানে, দেখা হয়ে যায় নিজের সঙ্গে।

  • Link to this news (এই সময়)