• ৫০ বছরের পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে তপন সেনের আজব সংগ্রহশালা
    এই সময় | ১৮ মে ২০২৫
  • মহম্মদ মহসিন, উলুবেড়িয়া

    প্রায় ৫০ বছরের বেশি পরিশ্রম ও বেনজির উদ্যোগ। বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক তপন সেন জীবনের সিংহভাগ সময়টাই কাটিয়ে দিয়েছেন মিশর–চিন–বাংলাদেশ–সহ দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন আনাচে–কানাচে। কখনও ছুটে গিয়েছেন বাংলার বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে, কখনও দেশের বিভিন্ন প্রদেশে তো কখনও বিদেশে।

    লক্ষ্য একটাই—লোকসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সামগ্রী সংগ্রহ করা। আর আজ তারই নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে উলুবেড়িয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক সংগ্রহশালা, যা সবার প্রশংসাধন্য হচ্ছে, সঙ্গত কারণেই।

    উলুবেড়িয়া এক নম্বর ব্লকের মহেশপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে শিক্ষা নিকেতনের পাশেই দেশ–বিদেশের প্রাচীন ও প্রায় অবলুপ্ত হাজারের বেশি গ্রামীণ সামগ্রী নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘বীরশিবপুর লোকসংস্কৃতি সংগ্রহশালা’। একটি ত্রিতল ভবনের পুরো দোতলায় বিরাট এলাকা জুড়ে দেশ–বিদেশের হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতি ও এককালের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস শোভিত হচ্ছে এই সংগ্রহশালায়।

    প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় গড়ে ওঠা সংগ্রহশালা দেশ–বিদেশের বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে। বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক তপন সেনের উদ্যোগে ছ’বছর আগে এই সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছিল।

    এই সংগ্রহশালায় মিশর,চিন,বাংলাদেশের জন্য আলাদা আলাদা জায়গা বরাদ্দ করা রয়েছে। বীরশিবপুর রেল স্টেশন থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে, গ্রামের ভিতরে এই সংগ্রহশালার মূল ফটকের উপরে রয়েছে কোমরে ঘট নিয়ে এক রানিপুতুলের ছবি।

    সংগ্রহশালের ভিতরে হারিয়ে যাওয়া পুতুলনাচের জন্য ব্যবহৃত ডাং পুতুল, সাপুড়েদের খাঁদি পুতুল, মেদিনীপুরের বেণী পুতুল। এ ছাড়া চিন, নেপাল, মিশর, বাংলাদেশ, আন্দামান–সহ দেশবিদেশের বহু হারিয়ে যাওয়া পুতুল এই সংগ্রহশালায় রয়েছে।

    তপন সেনের এই সংগ্রহশালার কথা জানতে পেরেছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের বর্ষীয়ান আইনজীবী আভা রায়। আভা দেবী গণেশ ঠাকুরের ভক্ত। তিনি যখনই দেশ বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন, সেখান থেকে গণেশের পুতুল সংগ্রহ করতেন। তাঁর সংগৃহীত ১৬ ধরনের গণেশ মূর্তিও এই সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে।

    এই পুতুল প্রদর্শনীর পাশাপাশি, একটি বড় জায়গায় স্থান করে নিয়েছে দেশ-বিদেশের মুখোশ। পুরুলিয়ার ছৌ নাচের মুখোশ তো আছেই। পাশাপাশি, বৌদ্ধদের তান্ত্রিক মুখোশ, হিমাচল প্রদেশের লাহুল স্পিতি নামে এক ধরনের প্রাচীন মুখোশ।

    এখন তো প্রত্যন্ত গ্রামেও বৈদ্যুতিক আলো চলে এসেছে। তবে যখন বিদ্যুৎ গ্রামে পৌঁছয়নি, তখন লম্ফ, হ্যারিকেন, হ্যাজাক, ডেলাইটের ব্যবহার ছিল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মতো। এইসব হারিয়ে যাওয়া জিনিসেরও স্থান হয়েছে সংগ্রহশালায়। বাদ্যযন্ত্রের ঘরে দেখা যাবে পুরুলিয়ার কেন্দরি, তিব্বতের বাঁশের বাদ্যযন্ত্র, রাজস্থানের লোকশিল্পের বাদ্যযন্ত্র, দেশবিদেশের হারিয়ে যাওয়া ইনস্ট্রুমেন্ট।

    বাংলাদেশের কাঁথা ও কোচবিহারের শীতলপাটি যা, এখন প্রায় পাওয়াই যায়‍ না, ‌তা ও স্থান পেয়েছে এই সংগ্রহশালায়।

    রয়েছে ত্রিপুরার হুঁকো, এমনকী, বিদেশের বিভিন্ন বিত্তশালী মানুষজন আগে যে পদ্ধতিতে মাদক সেবন করতেন সেই সবও রয়েছে সংগ্রহশালায়। রয়েছে দেশ-বিদেশের বহু প্রাচীন মুদ্রা।

    এক কথায় প্রদর্শনী খুঁটিয়ে দেখতে যে কোনও মানুষের কমপক্ষে এক ঘণ্টা সময় কোথা থেকে কেটে যাবে, বোঝাই যাবে না।

    অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক তপন সেন বলেছিলেন, হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতির সামগ্রী সংগ্রহের জন্য তিনি দেশের প্রায় সব রাজ্যই ঘুরেছেন। এই কাজ করতে গিয়ে সরকারি গ্রন্থাগারিক হিসেবে অবসরকালীন যা প্রাপ্য ছিল, তা–ও ব্যয় করে ফেলেছেন।

  • Link to this news (এই সময়)