লিগ পর্বের একটি ম্যাচ বাকি থাকতেই আইপিএলের প্লে-অফের দৌড় থেকে ছিটকে গিয়েছে গত বারের চ্যাম্পিয়নেরা। প্রথম পাঁচ দলের মধ্যে থাকার সম্ভাবনাও নেই কলকাতা নাইট রাইডার্সের। এই ব্যর্থতা কিন্তু কেকেআরকে ট্রফি দেওয়া দলের নয়। গত বছর সাফল্য পাওয়া দলকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিলেন কেকেআর কর্তৃপক্ষ। এ বারের হতাশাজনক ফল অনেকাংশে সেই পদক্ষেপের জন্যই।
লিগ পর্বে ১৪টির মধ্যে ১৩টি ম্যাচ খেলা হয়ে গিয়েছে কেকেআরের। দু’টি ম্যাচ বৃষ্টির জন্য পরিত্যক্ত হয়েছে। বাকি ১১টি ম্যাচের পাঁচটিতে জিতেছেন অজিঙ্ক রাহানেরা। ছ’টিতে হেরেছেন। তার মধ্যে রয়েছে পঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে ১১২ রান তাড়া করে জিততে না পারার লজ্জা। রয়েছে ঘরের মাঠে দিশাহীন চেন্নাই সুপার কিংসকে বাগে পেয়েও হারাতে না পারার আক্ষেপ। লখনউ সুপার জায়ান্টসের বিরুদ্ধেও প্রায় জেতা ম্যাচ হেরেছে কেকেআর। ম্যাচ হারার থেকেও কেকেআর কর্তৃপক্ষের বেশি আক্ষেপ হওয়া উচিত গত বারের চ্যাম্পিয়ন দল ধরে রাখতে না পারার। বেঙ্কি মাইসোরেরা দলের নিউক্লিয়াসটাই নষ্ট করে ফেলেছেন। কয়েক জন ক্রিকেটারের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতার মানসিকতা এবং পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল নিলামের সময়ই। শ্রেয়স আয়ার, মিচেল স্টার্ক, ফিল সল্টদের ধরে রাখার কোনও চেষ্টাই করেননি কেকেআর কর্তৃপক্ষ। অথচ তাঁরাই কেকেআরকে চ্যাম্পিয়ন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। প্রাক্তন অধিনায়ক নীতীশ রানার মতো মিডল অর্ডার ব্যাটারকেও ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়নি। একসঙ্গে এতগুলি পরিবর্তনে দলের ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলে কলকাতা। বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘কেকেআরের গোড়াতে গলদ। নিলামে দলই তৈরি করতে পারেনি। কোনও পরিকল্পনার ছাপ ছিল না। শ্রেয়স, সল্ট, স্টার্কে মতো ক্রিকেটারদের ছেড়ে দিয়েছে। অথচ সঠিক পরিবর্ত নিয়ে পারেনি কেকেআর।’’
সফল ওপেনিং জুটি ভেঙে ফেলা
গত মরসুমে প্রায় প্রতিটি ম্যাচে সফল হয়েছিল কেকেআরের ওপেনিং জুটি। সুনীল নারাইন এবং সল্টের দাপটে পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে অন্তত ৭০-৮০ রান তুলে ফেলত কেকেআর। দু’জনেই চালিয়ে খেলতেন। প্রতিপক্ষ দলের বোলারেরা বুঝতে পারতেন না কোথায় বল ফেললে, কেকেআরের ওপেনিং জুটিকে আটকানো যাবে। সফল ওপেনিং জুটি ধরে রাখতে পারেননি কেকেআর কর্তৃপক্ষ। নারাইনকে রাখা হলেও সল্টের ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখাননি মাইসোরেরা। ফলে নতুন দল তৈরির পরিকল্পনা শুরুতেই আলুনি হয়ে যায়। সল্ট আগ্রাসী ব্যাটারের পাশাপাশি উইকেটরক্ষক হিসাবেও দক্ষ। দলের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতেন। এ বার নারাইন ব্যাট হাতে ফর্মে ছিলেন না। সল্টের পরিবর্ত হিসাবে নেওয়া কুইন্টন ডি’কক একটি ম্যাচ ছাড়া দাগ কাটতে পারেননি। কোনও ম্যাচেই কেকেআরের ওপেনিং জুটিকে নির্ভরযোগ্য দেখায়নি। একটি ম্যাচেও ৫০ রানের জুটি তৈরি হয়নি। অথচ রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর জার্সি গায়ে সল্ট এ বারও শাসন করেছেন বোলারদের। তাঁর পরিবর্ত হিসাবে জস বাটলার বা ঈশান কিশনের কথাও ভাবা হয়নি।
পরীক্ষিত মিডল অর্ডার ধরে না রাখা
কেকেআরের নতুন দলের মিডল অর্ডারও এ বার বেশ দুর্বল। গত কয়েক বছর শ্রেয়স, নীতীশেরা ছিলেন কেকেআরের মিডল অর্ডারের শক্তি। তাঁরা দু’জনেই আবার দলকে নেতৃত্বও দিয়েছেন। দুই গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটারের দিক থেকে শুরুতেই মুখ ফিরিয়ে নেন কেকেআর কর্তৃপক্ষ। গত বছর ট্রফিজয়ী অধিনায়ক শ্রেয়স যে টাকা চেয়েছিলেন, তা দিতে রাজি হয়নি কেকেআর। দলকে সাফল্য এনে দেওয়ার পর তিনি যোগ্য মর্যাদা এবং গুরুত্ব পাননি বলেও এ বার আইপিএল শুরুর আগে অভিযোগ করেছিলেন শ্রেয়স। নীতীশ গত বছর চোটের জন্য খেলতে না পারলেও দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটার ছিলেন। বেঙ্কটেশ আয়ারও ছিলেন তাঁদের সঙ্গে। তাঁকেও এ বার শুরুতে ধরে রাখেননি কেকেআর কর্তৃপক্ষ। শেষে নিলামে বেঙ্গালুরুর সঙ্গে লড়াই করে ২৩.৭৫ কোটি দিয়ে তাঁকে কেনা হয়। সেটাও কিছুটা বাধ্য হয়ে। কারণ তার আগেই ভারতের প্রথম সারির সব ব্যাটারই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল কেকেআরের। সেই বেঙ্কটেশের ফর্মে না থাকাও প্রভাব ফেলেছে কেকেআরের পারফরম্যান্সে।
ফিনিশারদের অফ ফর্ম
কেকেআরের ব্যর্থতার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বেঙ্কটেশ আয়ার, আন্দ্রে রাসেল, রিঙ্কু সিংহ, রমনদীপ সিংহদের ফর্মে না থাকা। তাঁদের উপরই বেশি ভরসা ছিল দলের। রাসেল, রিঙ্কু, রমনদীপেরা ইনিংসের শেষ দিকে নেমে দ্রুত রান তুলতেন গত বছর। শেষ চার-পাঁচ ওভারে ৫০-৬০ রান যোগ করে দলের রান জেতার মতো জায়গায় পৌঁছে দিতেন। এ বার তাঁরা কেউই ধারাবাহিক ভাবে আগ্রাসী ব্যাটিং করতে পারেননি। দু’-একটি ম্যাচে চেনা মেজাজে দেখা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলের ইনিংস ভাল জায়গায় পৌঁছে দিতে পারেননি। পুরনো ফিনিশারেরও প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ।
বেহাল জোরে বোলিং
এ বার কেকেআরের জোরে বোলিং আক্রমণের দুর্বলতা দেখা গিয়েছে সব ম্যাচে। হর্ষিত রানা, বৈভব অরোরাকে দিয়ে সামলানো হয় পরিস্থিতি। হর্ষিত ভাল বোলার নিঃসন্দেহে। তবে এখনও যথেষ্ট অভিজ্ঞ নন। গত বছর তাঁর পাশে ছিলেন স্টার্কের মতো বোলার। কঠিন সময়ে পরামর্শ পেতেন। এ বার সেখানে পাশে বৈভব। আইপিএল খেতাব ধরে রাখার জন্য এই জুটি যথেষ্ট নয়। স্টার্কের পরিবর্ত হিসাবে নেওয়া হয় স্পেনসার জনসনকে। যিনি অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় সারির দলেও নিয়মিত নন! নেওয়া হয় অনরিখ নোখিয়াকে। দক্ষিণ আফ্রিকার এই জোরে বোলার চোটপ্রবণ। অধিকাংশ সময় মাঠের বাইরেই থাকেন। কেকেআর কর্তৃপক্ষেরও এই অভিজ্ঞতা অতীতে হয়েছে। তবু দলে নোখিয়া! জনসন বা নোখিয়া দু’জনেই হতাশ করেছেন। অথচ নিলামে মহম্মদ শামির জন্য এগিয়েও মাঝপথে হাল ছেড়ে দেয় কেকেআর।
স্পিন বোলিংয়ে ব্যর্থতা
বরুণ চক্রবর্তীকে ধরে রাখা হলেও ছেড়ে দেওয়া হয় সূয়ষ শর্মাকে। নেওয়া হয় অবসর নিয়ে ফেলা মইন আলিকে! যে তিন স্পিনারের জুটি গত বছর কেকেআরের সাফল্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল, সেই জুটিও নষ্ট করে ফেলা হয়। বরুণ এবং নারাইনও ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেননি এ বার। কিছু ওভারে তাঁরা প্রচুর রান খরচ করেছেন।
দুর্বল নেতৃত্ব
নিলামে কেকেআর কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনায় সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল নিঃসন্দেহে অধিনায়ক নির্বাচন করার ক্ষেত্রে। শ্রেয়সের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ার পরই উপযুক্ত বিকল্পের খোঁজ করা উচিত ছিল। নিলামে মাইসোর, চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতদের দেখে তেমন পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয়নি। শেষবেলার রাহানেকে ১.৫ কোটি টাকায় নেওয়া হয়। যাঁকে মূলত লাল বলের ক্রিকেটার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যিনি ২০১৮ সালের পর ভারতের হয়ে সাদা বলের ক্রিকেট খেলেননি। দেশের হয়ে মাত্র ২০টি টি-টোয়েনটি এবং ৯০টি এক দিনের ম্যাচ খেলেছেন ১৩ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবনে। কেকেআর ছাড়া আইপিএলের আর কোনও দল রাহানের নিতে আগ্রহ দেখায়নি। কোনও উপায় না থাকাতেই অভিজ্ঞতার কথা বিবেচনা করে রাহানেকে নেওয়া হয় খানিকটা বাধ্য হয়ে। বার বার একই ভুল করছেন অধিনায়ক রাহানে। বোলিং পরিবর্তন থেকে ফিল্ডিং সাজানো— প্রতি ম্যাচে এক ছবি দেখা গিয়েছে। কোনও বৈচিত্র ছিল না তাঁর নেতৃত্বে। বাঁধা গতে দল পরিচালনা করেছেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী বিকল্প সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। ঘরোয়া ক্রিকেটের সাফল্য দিয়ে ৩৬ বছরের রাহানেকে মাপতে যাওয়া বড় ভুল। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তাঁর নেতৃত্বের দুর্বলতা বোঝা উচিত ছিল মুম্বইয়ের পণ্ডিতের।
‘বুড়ো’ ক্রিকেটারদের উপর আস্থা
নতুন দল তৈরির সময় সাধারণত গুরুত্ব দেওয়া হয় নতুন প্রতিভা খুঁজে আনার উপর। তরুণ ক্রিকেটারদের দলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। যাতে পরের কয়েক বছর একটা দল ধরে রাখা যায়। তাতে দলের মধ্যে বোঝাপড়া ভাল হয়। কেকেআরের পরিকল্পনায় ঠিক উল্টো। শ্লথ হয়ে যাওয়া নারাইন, রাসেলের প্রতি কেকেআর কর্তৃপক্ষের অন্ধ আস্থা তো আছেই। বাকি ক্রিকেটার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও একই মানসিকতা দেখা গিয়েছে। নারাইন, রাসেল, রাহানে, মইনদের বয়স ৩৬-এর বেশি। মণীশ পাণ্ডে ৩৫। বরুণ ৩৩। ডি’কক ৩২। অর্থাৎ, প্রথম একাদশের অর্ধেক ক্রিকেটারই তরুণ নন। ২০ ওভারের ক্রিকেটের সঙ্গে যা বড্ড বেমানান।
গৌতম গম্ভীরের অনুপস্থিতি
কোচিং স্টাফের ক্ষেত্রেও কেকেআরের ঘাটতি চোখে পড়ার মতো। গত বার গৌতম গম্ভীরে মেন্টর করে এনেছিলেন শাহরুখ খান। কেকেআরকে দু’বার আইপিএল দেওয়া প্রাক্তন অধিনায়কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল দলকে আবার সাফল্যের রাস্তায় ফিরিয়ে আনতে। তিনি ভারতীয় দলের কোচ হয়ে যাওয়া সেই সুবিধা হাতছাড়া হয়। কেকেআর শিবিরকে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটিও দিয়েছেন গম্ভীরই। জাতীয় দলের দায়িত্ব পাওয়ার পর অভিষেক নায়ার, রায়ান টেন দুশখাতেকেও সঙ্গে নিয়ে যান সহকারী হিসাবে। ফলে গত কয়েক বছর যাঁরা কেকেআরের সাপোর্ট স্টাফ ছিলেন, তাঁরাও হাতছাড়া হন। এই বিষয়টি নিয়েও ভাবা উচিত ছিল মাইসোরদের। কোচ পণ্ডিত ২০২৩ সালেও দলকে সাফল্য দিতে পারেননি। গম্ভীর চলে যাওয়ায় দলের যে ক্ষতি হয়েছে, তা প্রতিযোগিতার মাঝেই বলে ফেলেন হর্ষিত।
কেকেআর কর্তৃপক্ষ
সফল বা সম্ভাবনাময় ক্রিকেটারদের ধরে রাখার ক্ষেত্রে কেকেআরের দুর্বলতা নতুন নয়। বলা যায় শুরু থেকেই। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো অধিনায়কের উপর আস্থা রাখতে পারেননি তাঁরা। সূর্যকুমার যাদব, শুভমন গিলদের দলে নিয়েও ছেড়ে দিয়েছে কেকেআর। রিকি পন্টিং, ক্রিস গেল, অজন্তা মেন্ডিস, ব্রেন্ডন ম্যাকালাম, দীনেশ কার্তিক, শেন বন্ড, সঞ্জু স্যামসন, ট্রেন্ট বোল্ট, মর্নি মর্কেলের মতো ক্রিকেটারদেরও অতীতে ধরে রাখার আগ্রহ দেখায়নি কেকেআর। তালিকা দীর্ঘ। বছরের পর বছর একই রোগে আক্রান্ত কেকেআর কর্তৃপক্ষ। এই ব্যর্থতার দায় তাঁদের দুর্বল এবং অদূরদর্শী পরিকল্পনাও। বলা যায়, দল তৈরির সময়ই খেতাব ধরে রাখতে পারেনি কেকেআর।