• বেসরকারি বাস সংগঠনগুলির দিন দিনের ধর্মঘটের ডাক, সফলতা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন
    দৈনিক স্টেটসম্যান | ১৯ মে ২০২৫
  • সুকুমার রায়ের ‘সৎ পাত্র’ কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন আমাদের সকলেরই জানা– ‘উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে,
    ঘায়েল হয়ে থামল শেষে’। এই কবিতার সঙ্গে কোথাও যেন মিল থেকে যাচ্ছে রাজ্যের বেসরকারি বাস সংগঠনের বিভিন্ন সময়ে ডাকা ধর্মঘটের চালচিত্রের মধ্যে। জনপ্রিয় এই কবিতার আলোচ্য পাত্র ‘গঙ্গারাম’ থামলেও এরাজ্যের বেসরকারি বাস মালিকরা বার বার ব্যর্থ হয়েও কিন্তু থামতে রাজি নন। তাঁরা তাঁদের লড়াই চালিয়ে যেতে চান। তাঁদের আন্দোলনের খতিয়ান ঘাটলে দেখা যাচ্ছে, গত ১৪ বছরে পাঁচবার ধর্মঘট ডেকে মাত্র একবার সফল হয়েছেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা এবার বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। আর সেই আন্দোলন এক-আধ দিনের নয়, টানা তিনদিন অর্থাৎ ৭২ ঘন্টা। আগামী ২২, ২৩ ও ২৪ মে রাজ্যের বেসরকারি বাস সংগঠনগুলির একাংশ এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। কিন্তু তাদের এই আন্দোলন কতটা সফল হবে, তা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন। খোদ পরিবহন দপ্তরেই বিষয়টি নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

    জানা গিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তিন দিনের এই বেসরকারি বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে পরিবহণ বাঁচাও কমিটি। এই ধর্মঘটে অংশ নিচ্ছে পাঁচটি বাসমালিক সংগঠন জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেট (পশ্চিমবঙ্গ), বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট, ওয়েস্ট বেঙ্গল বাস মিনিবাস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, মিনিবাস অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটি এবং ইন্টার অ্যান্ড ইন্ট্রা রিজিয়ন বাস অ্যাসোসিয়েশন। ধর্মঘটের পিছনে তাদের দাবি, ১৫ বছরের পুরনো বাস বাতিলের সিদ্ধান্তের স্থগিত করতে হবে। কারণ কোভিড-১৯ মহামারির সময় দু’বছর বাস চলাচল বন্ধ ছিল। সেই সঙ্গে পুলিশি হয়রানি ও ইচ্ছামতো টোল ট্যাক্স আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। ডিজ়েলের মূল্যবৃদ্ধি ও অন্যান্য সমস্যার সমাধান চেয়ে মোট পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। এ ব্যাপারে বেসরকারি বাস মালিকরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়েছেন। সেই চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, ২০ মে-র মধ্যে যদি তাঁদের দাবিগুলির বিষয়ে সরকার সদর্থক পদক্ষেপ না করে, তবে ২২ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত টানা ৭২ ঘণ্টা বেসরকারি বাস পরিষেবা বন্ধ থাকবে। এই ধর্মঘটের ফলে নিত্যযাত্রীরা বড়সড় সমস্যার সম্মুখীন হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেজন্য বিকল্প পরিবহণের ব্যবস্থা করার জন্য যাত্রীদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

    প্রসঙ্গত ২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নানা সময়ে ধর্মঘটের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বেসরকারি বাসমালিকরা। বেসরকারি বাস সংগঠনগুলির তথ্য অনুযায়ী, গত ১৪ বছরে পাঁচ বার বেসরকারি বাস ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সফল হয়েছেন মাত্র এক বার। তখন রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। সেই সময়ে প্রথম বার ২০১২ সালের জুলাই মাসে বাসভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হলেও, পরিবহণমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর তা স্থগিত হয়ে যায়। ফের ওই বছর অক্টোবর মাসে বাসমালিক সংগঠনগুলি আবারও ধর্মঘটের ডাক দেয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার পর ফের সেই ধর্মঘটও প্রত্যাহার করে নেন বাস মালিকরা।

    এরপর ২০১৪ সালে শিলিগুড়িতে বেসরকারি বাস সংগঠনগুলি এক ছাতার তলায় আসে। সেই সময় তারা একটি কর্মসূচির মাধ্যমে তিন দিনের বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। সে বছর জুন মাসে ৭২ ঘণ্টার বাস ধর্মঘটের ডাক দিলেও মাত্র এক দিনের জন্য ধর্মঘট হয়। এই ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিনে পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের আশ্বাসে ধর্মঘট মাঝপথে স্থগিত হয়ে যায়। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাসমালিক সংগঠনগুলি ধর্মঘটের হুমকি দিলেও তা কার্যকর হয়নি। সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর বিষয়টি থেমে যায়। সেই সময় রাজ্যে পরিবহণমন্ত্রী ছিলেন না। তার জায়গায় বিষয়টি সামাল দেন পরিবহণসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে যখন করোনা সংক্রমণে সবাই তটস্থ, তখন তিন দিনের বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল বাস মালিক সংগঠনগুলি। কিন্তু মুখ্যসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর সেটাও স্থগিত হয়ে যায়।

    এছাড়া ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের অস্থায়ী কর্মীরা প্রায় এক সপ্তাহের ধর্মঘট পালন করেন। এরপর পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীর আশ্বাসের পর প্রত্যাহার করা হয়। এভাবে ২০১১ সাল থেকে তৃণমূল জমানায় প্রধানত বাসভাড়া বৃদ্ধি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, এবং প্রশাসনিক সমস্যার প্রতিবাদে একাধিক বার পরিবহণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে। প্রতিবারই রাজ্য সরকার সুচারুভাবে সামাল দিয়েছে।

    উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে কোনও ধর্মঘটের বিরোধী। কারণ এই ধর্মঘটের ফলে রাজ্যের সাধারণ মানুষের ভোগান্তি শুধু নয়, অর্থনৈতিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হতে হয়। নিত্য যাতায়াত করা শ্রমিক ও কর্মচারীদের বহু শ্রমদিবস নষ্ট হয়, ক্ষতি হয় বিভিন্ন শিল্প ও কারখানার। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়ে সরকারের কোষাগারেও। সেজন্য মুখ্যমন্ত্রী এ রাজ্য থেকে ধর্মঘট সংস্কৃতি একেবারে তুলে দিতে চান। তাই ধর্মঘটের পরিস্থিতি আগাম অনুমান করে সোমবার কসবার পরিবহণ ভবন-২ -এ বাসমালিক সংগঠনগুলিকে নিয়ে বৈঠকে বসছে পরিবহণ দপ্তর। যদিও রাজ্যে এমন কিছু বাস সংগঠন রয়েছে, যারা এই ধর্মঘটের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নয়। বৈঠকের আগে ধর্মঘটের বিরুদ্ধে বেসরকারি বাস সংগঠনগুলির একাংশ বিরূপ মত পোষণ করায় কিছুটা হলেও ‘ব্যাকফুটে’ এই তিনদিনের ধর্মঘটের আবেদনকারীরা।
  • Link to this news (দৈনিক স্টেটসম্যান)