কাগজ কুড়ানির ‘টিপ’ থেকেই খুনের কিনারা, গড়িয়াহাট হত্যায় দু’মাস পর গ্রেপ্তার ৪
বর্তমান | ১৯ মে ২০২৫
নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: প্রায় দু’মাস আগের ঘটনা। মার্চের ২৬ তারিখ গড়িয়াহাট থানা এলাকার পূর্ণ দাস রোডের বাসিন্দা বিনোদ দাসের (৩৮) দেহ উদ্ধার হয় বাড়ির অদূরে। ময়নাতদন্তের রিপোর্টেই খুনের ইঙ্গিত মিলেছিল। সেই মতো তদন্ত শুরু করে পুলিস। কিন্তু কোনও ‘ক্লু’ পাচ্ছিলেন না তদন্তকারীরা। এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বা মৃতের ফোনের কল রেকর্ড থেকেও কোনও সূত্র মিলছিল না। ঘটনার ৫৩ দিন পর সেই খুনের কিনারা করল গড়িয়াহাট থানা। এক কাগজ কুড়ানির দেওয়া ‘টিপ’ থেকেই তদন্ত মোড় নেয়। দেহ লোপাটের চেষ্টার এক প্রত্যক্ষদর্শীর ভূমিকাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই খুনের ঘটনায় শনিবার রাতে পুলিস গ্রেপ্তার করেছে নীলাঞ্জন গোস্বামী ওরফে বাবলা, শুভদীপ ল ওরফে বাবু, অরবিন্দ কুমার সাউ এবং যোগেন্দার চৌধুরী নামে চারজনকে। প্রথম দু’জন বিনোদেরই বন্ধু।
অবাক করা বিষয় হল, খুনের পর বাবলা নিজেই বিনোদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঘুরছিল। বন্ধুবিয়োগে রীতিমতো ভেঙে পড়ার ভান করছিল সে। তদন্তকারী অফিসারকে সে বলে, ‘স্যর, আপনারা অপরাধীকে খুঁজে বের করুন। কঠোর শাস্তি চাই।’ তদন্তকারীদের কথায়, পরিবারের সঙ্গে সারাক্ষণ থেকে সে আসলে বুঝে নিতে চাইছিল, তারা কী করতে চাইছে। পুলিস কোন পথে এগচ্ছে, তারও খবরাখবর পাচ্ছিল সে। বিনোদের দেহ উদ্ধার হওয়ার পর বাইরে থেকে কোনও আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়নি। ময়নাতন্তের রিপোর্ট হাতে আসার পর পুলিস জানতে পারে, মৃতের পাঁজরের হাড় ভাঙা ছিল। পেট, বুক কিডনিতে আঘাত করা হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে পুলিস জানতে পারে, ক্রমাগত কিল, ঘুষি লাথি মারা হয়েছে যুবককে। তখন খুনের মামলা শুরু করে থানা।
কিন্তু কোথাও কোনও সূত্র না মেলায় ধন্দে পড়ে পুলিস। সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখা শুরু হয়। বিনোদের বন্ধু ও ঘনিষ্ঠদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এই অবস্থায় এপ্রিলের শেষের দিকে বিনোদের বাবার সঙ্গে এক কাগজ কুড়ানির দেখা হয়। কথা প্রসঙ্গে ছেলের মৃত্যুর কথা উঠতেই তিনি জানান, ২৬ মার্চ সকাল ৬টার দিকে বিনোদকে দু’জনের সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরতে দেখেছিলেন তিনি। বিনোদের বাবা বলেন, ‘ছেলে তো দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। সকাল ছ’টায় তাকে দেখতে পাওয়া কীভাবে সম্ভব!’ কাগজ কুড়ানি জানান, বিনোদের সঙ্গে বাবলা এবং আরও এক যুবক ছিল তখন। তার এক-দু’দিনের মধ্যে বিনোদের বাবাকে স্থানীয় এক দোকানদার জানান, ওই সকালে তাঁর ছেলেকে কম্বলে মুড়িয়ে চারজন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তারাই দেহ ফেলে গিয়েছে। সুস্থ-সবল একটি লোককে কেন কম্বলে মুড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে? পুলিসকে গোটা বিষয়টি জানান তিনি। গড়িয়াহাট থানার ওসি অঞ্জন সেন ও তদন্তকারী অফিসাররা দ্রুত কথা বলেন ওই কাগজ কুড়ানি ও দোকানদারের সঙ্গে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাবলা সহ চারজনকে আটক করা হয়। দীর্ঘ জেরায় বাবলা ভেঙে পড়ে জানায়, সে এবং আরও তিনজন মিলে খুন করেছে বিনোদকে। একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত বাবলা পুলিসকে জানিয়েছে, বিনোদ তার কাছে ১৪ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। পাঁচ হাজার টাক শোধ করলেও বাকি টাকার জন্য বারবার ঘোরাচ্ছিল। তাই বিনোদকে বাড়ি থেকে ডেকে এনে বেধড়ক মারধর করে। তাতেই মৃত্যু হয়। দেহ ফেলে দিয়ে পালায় সবাই। নিজেরা মোবাইল ব্যবহারও বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরা পড়তেই হল। তদন্তকারী এক অফিসারের কথায়, ‘আসলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে!’