• বন্ধুকে খুন করে কান্না, ধরালেন ফেরিওয়ালা
    এই সময় | ১৯ মে ২০২৫
  • ছোটবেলার বন্ধুর মৃত্যুতে হাউ হাউ করে কেঁদেছিল চারমূর্তি। বন্ধুর মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে তারা আক্ষেপ করে বলেছিল, ‘একসঙ্গে কত ফুটবল খেলেছি, আড্ডা দিয়েছি। আমাদের ছেড়ে এ ভাবে ও চলে যেতে পারল!’ চার বন্ধুর অঝোরে কান্না দেখে কারও কারও মন্তব্য ছিল, ‘ওদের মতো বন্ধু যেন সবাই পায়।’

    সেটা ২৬ মার্চের ঘটনা, গড়িয়াহাট লাগোয়া পূর্ণদাস রোডে ভাড়া থাকা বিনোদ দাসের (৪০) মৃতদেহ সে দিন উদ্ধার করা হয় তাঁর ঘর থেকে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ মনে করেছিল, অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে অসুস্থ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

    কিন্তু তার দেড় মাসের কিছু বেশি সময় পর বেরোল, বিনোদকে আসলে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে এবং ঘটনার ৫২ দিনের মাথায়, শনিবার অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার করা হলো সেই চার জনকে— বন্ধুর অকালমৃত্যুতে যারা কেঁদে ভাসিয়েছিল। পুলিশ জানায়, ধৃতদের নাম: নীলাঞ্জন গোস্বামী ওরফে বাবলা, শুভদীপ ল ওরফে বাবু, অরবিন্দকুমার ঝা এবং যোগেন্দ্র চৌধুরি।

    ঘটনাটা যে অন্য রকম, তার প্রাথমিক ইঙ্গিত পাওয়া যায় দু’জনের কথা থেকে— এক জন স্থানীয় পান দোকানদার, অন্য জন এক ফেরিওয়ালা। দিন চারেক আগে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে আসা বিনোদ দাসের ময়না তদন্ত রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট হয় যে, তাঁকে খুন–ই করা হয়েছে।

    ময়না তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, পাঁজরের চারটি হাড় এবং অন্য কিছু হাড় ভাঙার কথা। গড়িয়াহাট থানায় রুজু হওয়া অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা পাল্টে যায় খুনের মামলায়। এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, ময়না তদন্ত রিপোর্ট আসতে দেড় মাসের বেশি সময় কেন লাগল?

    প্রায় এক দশক আগে কলকাতা হাইকোর্ট একটি রায়ে জানিয়েছিল, ময়না তদন্ত রিপোর্ট ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দিতে হবে আর যদি সেটা না–দেওয়া যায়, তা হলে তার কারণ দর্শাতে হবে অটোপসি সার্জন বা মর্গের তরফে।

    তবে হাইকোর্টের ওই নির্দেশ মানা যে হচ্ছে না, সে কথা কলকাতা পুলিশের একাংশ বেশ কিছু দিন ধরে বলে আসছেন। এক সিনিয়র অফিসারের বক্তব্য, ‘ওই চার জন অন্যত্র পালিয়ে গেলে আমাদের বিস্তর সমস্যা হতো। এ ধরনের ঝুঁকি এড়াতেই ময়না তদন্ত রিপোর্ট তাড়াতাড়ি আসা জরুরি।’

    পুলিশ জানায়, বিনোদরা আসলে বিহারের বাসিন্দা। কাজের সূত্রে বিনোদ ও তাঁর বাবা বিশুল দাস থাকতেন পূর্ণ দাস রোডে। ঘটনা যে দিনের, সেই সময়ে বিশুল ছিলেন বিহারে। বিনোদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন মেলেনি। দুঁদে গোয়েন্দা অফিসারদের বক্তব্য, ঘুষি, লাথি, কিল মেরে কাউকে খুন করা হলে বাইরে থেকে শরীরে চিহ্ন না-মেলারই কথা।

    ধৃত চার জনের সঙ্গেই ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্ব ছিল বিনোদের। তারাই পুলিশ এবং অন্যদের জানিয়েছিল বিনোদের অতিরিক্ত মদ্যপানের কথা। তাদের মধ্যে কেয়াতলার বাসিন্দা, নীলাঞ্জন গোস্বামী ওরফে বাবলা নামী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী। বিনোদ দি কম পাশ করলেও ভালো কাজ পাননি। বিনোদ যাতে ভালো কাজ পান, তার জন্য তাঁকে ইংরেজি শেখাতেন বাবলা।

    বিহারে গিয়ে ছেলের শেষকৃত্য করে বিশুল দাস কলকাতায় আসার কিছু দিন পর তাঁকে এক পরিচিত কাগজওয়ালা জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার ছেলের কী হয়েছিল? দেখি, ওর বন্ধুরা ওকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।’ শুনে অবাক হয়ে যান বিশুল।

    কারণ, বিনোদের বন্ধুরা তো জানিয়েছিল, ঘরে এসে বিনোদকে ওরা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পেয়েছে। তার পর স্থানীয় এক পান দোকানদারও একই কথা বলেন। পুলিশ সূত্রের খবর, দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের মুখে চার জন স্বীকার করে, বাবলার কাছ থেকে ধার নেওয়া ৯ হাজার টাকা বিনোদ শোধ করতে পারছিলেন না এবং এই নিয়ে বচসার জেরে বাবলা ও বাকি তিন জন মিলে ২৬ মার্চ বিনোদকে তাঁর ভাড়া ঘরের কাছে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে ব্যাপক মারধর করে। তার পর নিথর বিনোদকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে নাটক শুরু করে চার জন।

  • Link to this news (এই সময়)