সুমন ঘোষ, মেদিনীপুর
তখনও সাংগঠনিক ভাবে জেলা ভাগ হয়নি। অজিত মাইতি ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের সভাপতি। পরে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের কো-অর্ডিনেটরও হয়েছিলেন। ২০২৩ সালে সেই পদেরও অবলুপ্তি ঘটে।
সে সময়ে একবার দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ‘অজিত অনেক পুরোনো কর্মী। তবে ওর কিছু দোষও রয়েছে। গ্রুপবাজি করে!’ তারপরেও পিংলার বিধায়ক, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি সেই অজিত মাইতিকেই ফের পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল সাংগঠনিক জেলার সভাপতি করা হলো!
তৃণমূলে যখন প্রবীণদের সরিয়ে আপাত নবীনদের নানা পদে তুলে আনা হচ্ছে, সেখানে উল্টো পথে হেঁটে প্রায় সত্তর বছরের অজিত মাইতিকেই কেন বেছে নেওয়া হল সভাপতি পদে? তৃণমূলের অন্দরের খবর, এর পিছনে ঘাটালের তারকা-সাংসদ দীপক অধিকারী ওরফে দেব এর হাত রয়েছে।
আর সেই কারণেই সভাপতি ঘোষণা হওয়ার পরেই দেব ভিডিয়ো কলে অজিত মাইতির সঙ্গে কথা বলেন। সেইকলে অজিত মাইতিকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘তোমাকে ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা। খুব শিগ্গির তোমার ঘাটালে আসার অপেক্ষায় থাকলাম। তুমি এসো।’ পাল্টা দেবও বলেন, ‘দাদা, আপনাকে কনগ্র্যাচুলেশন।’
দলীয় সূত্রের খবর, সাংসদ দেব ঘাটাল সাংগঠনিক জেলায় সভাপতি করার জন্য অজিত মাইতির হয়েই সওয়াল করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীও তাতে সিলমোহর দেন। দেবের সেই ইচ্ছেতে অজিতেরও ইচ্ছেপূরণ হয়েছে। পুনরায় জেলা সভাপতির পদে ফিরতে পেরেছেন। তাই দেবকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভোলেননি।
কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, দেব কেন অজিত মাইতিকে সভাপতি করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে গেলেন? দলীয় সূত্রের খবর, এই সময়টা ঘাটালের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের একটি বৃহৎ প্রকল্প, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণের কাজ চলছে।
এটা ঠিক যে, কাজ করবে প্রশাসন ও সেচ দপ্তর। কিন্তু সেখানে দলেরও অনেক ভূমিকা থেকে যায়। কেউ ঠিকাদারদের বিরক্ত করছে কি না, কোনও অজুহাতে দলের নাম করে টাকা চাইছে কি না, কোথাও কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে কি না, বিরোধীরা চক্রান্ত করছে কি না— এমন নানা বিষয়ে নজরদারি প্রয়োজন। তার পাশাপাশি দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও রয়েছে।
আবার ওই সাংগঠনিক জেলার মধ্যেই রয়েছে সবং। যেখানে রয়েছেন প্রবীণ নেতা মানস ভুঁইয়া। যাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কথা বলাই বাহুল্য। বাম আমলেও তিনি কংগ্রেসের টিকিটে জিতে সবংয়ে বিধায়ক হয়েছেন। তৃণমূল জমানাতেও তাঁর জয় আটকানো যায়নি।
যদিও একটি বিশেষ কারণে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। তৃণমূলের আরও বহু নেতা কংগ্রেস থেকে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গেও মানসের পুরোনো সম্পর্ক রয়েছে। তিনি না-চাইলেও তাঁর কাছে রাজনৈতিক শিক্ষালাভ থেকে পথ চলার দিশা পেতে বিভিন্ন ব্লকের নেতাকর্মীরা আসেন। আর এমন বেশ কিছু কারণে জেলার দলীয় কোনও পদে না-থাকলেও সবংয়ের পাশাপাশি ডেবরা, পিংলার একটি অংশ তাঁকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।
দেবের সঙ্গে মানসের ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা জেলার কারও অজানা নয়। আবার অজিতের অবস্থান মানসের বিরোধী শিবিরে। এ ছাড়াও কয়েকটি ব্লকে বিধায়ক ও ব্লক সভাপতির বনিবনা নেই। এই সমস্ত সমস্যা মিটিয়ে, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কাজ যাতে সহজে করা যায় সেই কারণেই দেব অজিত মাইতিকে চেয়েছিলেন বলেই দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে।
কারণ, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণের কথা প্রথম লোকসভায় টিকিট পাওয়ার পরেই ঘোষণা করেছিলেন দেব। তাই বর্তমানে মানস ভুঁইয়ার বিরোধী শিবিরে থাকা অজিত মাইতিকেই দেব চেয়েছেন বলে দলের প্রবীণ নেতারা জানিয়েছেন।
যদিও এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি রাজ্যের মন্ত্রী তথা সবংয়ের বিধায়ক মানস ভুঁইয়া। তিনি বলেন, ‘আমি জেলার কোনও রাজনৈতিক পদে নেই। ফলে রাজনীতি নিয়ে কিছু বলব না।’
আর নতুন সভাপতি অজিত মাইতির কথায়, ‘রাজনীতির আঙিনায় দেবের নিজস্ব একটা দর্শন আছে। আমি সেই দর্শনকে সমর্থন করি। সত্যি কথা বলতে দেব চেয়েছিলেন, আমি সভাপতি হই। তবে দিদিও (মমতা) চেয়েছিলেন। না হলে তিনি দেবের প্রস্তাবে সিলমোহর দেবেন কেন? আমার লক্ষ্য, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান থেকে শুরু করে সমস্ত উন্নয়নে সাহায্য করা। দলের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে চলা। কারণ, ২০২৬-এর নির্বাচনে ভালো ফল করতেই হবে।’