সব্যসাচী ঘোষ, মালবাজার
জেলা সদর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের পালংঘাট গ্রামে বাড়ি ফুটফুটে মেয়ে কমলার। সেই গ্রামেই মামাবাড়ি ছিল কমলার বয়সি আর একটি মেয়ে গীতা দত্তের। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার শেষে জেলা সদর শহরে বাবার সঙ্গে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরে কমলা।
পুরোনো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হবে যেমন, সেই সঙ্গে গ্রামের মেয়ের প্রথম একটা আস্ত শহর দর্শনের লোভও রয়েছে। জেলা সদর শহরটার নাম শিলচর। শহর জুড়ে তখন চলছে ভাষার মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন।
অসম রাজ্যের বাঙালি প্রধান বরাক উপত্যকা জুড়ে বাংলাকে প্রধান ভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন চলছে। নানা সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং রেল স্টেশনে অবরোধ, বিক্ষোভ চলছে। কমলা সে দিন বাংলা ভাষার সেই আন্দোলনের কথা শুনে রেল স্টেশনে চলে এসেছিল। সেটাই তার জীবনের প্রথম ও শেষ রেল স্টেশন দর্শন। নিথর দেহ হয়ে ফিরেছিল কমলা।
বাংলার মর্যাদার দাবিতে প্রথম ও একমাত্র মহিলা ভাষা শহিদ কমলা ভট্টাচার্য। ১৬ বছর বয়সি সেই কমলার বান্ধবী গীতা আজ বিরাশি বছরের প্রবীণা। শিলচর শহরের দেশবন্ধু রোডের নিজস্ব বাড়িতে বসে এ দিনও বান্ধবী কমলার কথা মনে করেছেন তিনি। শিলচর মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যক্ষা হিসেবে কর্মজীবন শেষ করেছেন।
তাঁর স্বামী মিহির দত্ত জিসি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। গীতা দেবীর ভাইঝি মধুমিতা ধর মালবাজার শহরে থাকেন। মালবাজার ব্লকের ওদলাবাড়ি সুনীল দত্ত স্মৃতি গার্লস স্কুলের তিনি প্রধান শিক্ষিকা। তাঁরও আদি বাড়ি কাছাড় জেলার শিলচরে। রক্তঝরা সেই দিনে জন্ম না হলেও পরবর্তীতে সেই বর্ণনা বারবার অ্যালবামে কমলা শুনেছেন তিনি। মাসি গীতা দেবীর সঙ্গে মধুমিতার নিত্য যোগাযোগ।
আজ, সোমবার ১৯ মে-র সেই ঘটনার ৬৪ বছর পূর্ণ হবে। ঘটনা ১৯৬১ সালের। প্রতি বছর সকাল থেকে শিলচরের বাসিন্দারা তারাপুর রেল স্টেশন থেকে মিছিল শুরু করেন, যেখানে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। বান্ধবীর স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে যান গীতা দেবীও।
এ দিন মধুমিতা দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা বলেন মাসির সঙ্গে। গীতা বলেন, ‘কমলা আন্দোলনে কৌতূহলী হয়ে দেখতে এসে জড়িয়ে পড়েছিল। তখন ওকে গুলির শিকার হতে হয়। পুলিশ লোকচক্ষুর আড়ালে ১১টা দেহ ধীরে ধীরে বের করে নিয়ে যায়। শিলচর শহরে কারও বাড়িতে সেদিন আর হাঁড়ি চড়েনি। অথচ এই দিনটাকে অনেকেই ভুলে গিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গে সে ভাবে পালিতই হয় না।’
সে দিনের শোক থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি শিলচর। ৫৫ ছুঁতে চলা মধুমিতা অসম নিবাসী প্রাবন্ধিক তথা অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যের ছাত্রী। বাংলা ভাষার দাবিতে যে ১১টা টাটকা প্রাণ সে দিন চলে গিয়েছিল, তা নিয়ে হাজার হাজার লাইন লিখে ফেলেছেন তপোধীর। কিন্তু ওরা থাকে ও ধারের মতোই বাংলা ভাষার জন্য দাবির সেই রক্তঝরা ১৯ মে পশ্চিমবঙ্গের যেন অনেকেই ভুলতে বসেছেন। পশ্চিমবঙ্গের থেকে গুরুত্ব না পাওয়াটাই যেন ওদের ১৯ মে-র যন্ত্রণাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে।