• Positive News: মেদিনীপুরের এই স্কুলে আছে বাচ্চাদের ‘ব্যাঙ্ক’, ‘হাসপাতাল’
    এই সময় | ২০ মে ২০২৫
  • মণিরাজ ঘোষ

    সরকার পোষিত প্রাথমিক স্কুলের ভিতর রয়েছে বাচ্চাদের নিজেদের ব্যাঙ্ক, হাসপাতাল, অডিটোরিয়াম। শুনে চমকে উঠতে পারেন অনেকেই। তবে এটাই সত্যি। আর হাতে হাত রেখে তা সত্যি করে তুলেছে স্কুলের কচিকাচা ও শিক্ষকরা। মেদিনীপুরের খড়্গপুর গ্রামীণের হিজলি সংলগ্ন কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

    সেই স্কুলে কাচের আলমারিতে থরে থরে সাজানো লক্ষ্মীর ভাঁড়। তাতে বড় বড় করে লেখা ‘ব্যাঙ্ক’। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৫টি তাক। তাতেই থরে থরে সাজনো টাকা রাখার সেই ভাঁড়গুলি। তাতে নাম লেখা রয়েছে সঞ্জনা, রুবিনা, সৌমি, আফরিন, মানস, সাইনাদের। ওরা প্রতিদিন তাতে ১ টাকা, ২ টাকা করে জমায়।

    স্কুলের বারান্দার একটা পাশে রাখা ছোট্ট চৌকি। লেখা, ‘শুশ্রূষা হাসপাতাল’। একটি ফ্যানও রয়েছে। হঠাৎ করে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ওখানেই শোওয়ানো হয়। থাকে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। একটু এগিয়ে ‘স্বাবলম্বী কক্ষ’। সেখানে সেলাই মেশিন রাখা। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই ছোট্ট একটি অডিটোরিয়াম। আছে টিভি, প্রজেক্টর।

    সম্প্রতি সমগ্র শিক্ষা মিশনের উদ্যোগে জেলাব্যাপী যে ‘শিখন শিক্ষণ উপকরণ’ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তাতে জেলার প্রায় সাড়ে ৩ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম হয়েছে এই স্কুল। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা তনুশ্রী দাস ‘শিক্ষারত্ন’। ২০২০ সালে এই সম্মান পান তিনি।

    ২০২২ সালে কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় সরকারের স্বচ্ছ বিদ্যালয় পুরস্কার সম্মানও পেয়েছে। ২০২৩ সালে রাজ্য সরকারের নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কারও পায় এই স্কুল। ১৯৯৯ সাল থেকে শিক্ষকতা করলেও ২০১৬ সালে কুচলাচাটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তনুশ্রী দাস।

    বর্তমানে এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। ছাত্রছাত্রী প্রায় ১৭৫ জন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা-সহ মোট ৬ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন এই স্কুলে। সহকর্মীদের সহযোগিতাতেই স্কুলকে এ ভাবে সাজিয়ে তুলেছেন তনুশ্রী দাস। স্কুলের দেওয়াল থেকে শ্রেণিকক্ষ, সবেতেই অভিনবত্বের ছোঁয়া।

    ক্লাসরুমগুলির অভিনব নাম। অঙ্কের ক্লাস আর্যভট্টের নামে, বাংলার ক্লাসরুম বিদ্যাসাগরের নামে, ইংরেজির ক্লাসরুমের নাম এপিজে আব্দুল কালামের নামে। পরিবেশ সংক্রান্ত পঠনপাঠন হয় যে ক্লাসরুমে, তার নামকরণ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর নামে। শিল্পকলার জন্য আছে যামিনী রায় কক্ষ। প্রতিটি ক্লাসরুমেই রাখা আছে বিষয়ভিত্তিক অসংখ্য শিক্ষা উপকরণ বা টিচিং লার্নিং ম্যাটেরিয়াল। যা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তত্ত্বাবধানে ছাত্রছাত্রীরাই তৈরি করেছে। ক্লাসরুমের সিলিং বা ছাদেও কারুকার্য। সিলিংয়ে চোখ মেললে দেখা যাবে, সপ্তর্ষিমণ্ডল, কালপুরুষ।

    প্রধান শিক্ষিকার কথায়, প্রত্যন্ত এই এলাকার বেশির ভাগ পরিবারই আর্থিক ভাবে পিছিয়ে। যখন প্রাথমিক স্কুল থেকে বেরিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হতে যায়, সামান্য ভর্তির টাকাটুকু বা বইপত্র কেনার টাকাও থাকে না। তাই এই ব্যাঙ্ক-ব্যবস্থা। এক দু’ টাকা করে জমিয়ে যা হয়, হাইস্কুলে ভর্তির সময় কাজে লাগে। ২০১৭ সাল থেকে প্লাস্টিকের কৌটো, যা অবিকল লক্ষ্মীর ভাঁড়ের মতো দেখতে, তাতেই টাকা জমানো শুরু হয়। শিশু সংসদের ছেলে মেয়েরাই তা দেখভাল করে। ওই ভাঁড়ে ওরা ওদের সুবিধা মতো ১ টাকা, ২ টাকা, ৫ টাকা করে জমায়।

    ছাত্রছাত্রীদের সেই জমানো টাকা যে মাঝে মধ্যে তাঁদের পরিবারের বিপদের সময়ও কাজে লাগে, তাও জানান স্কুলের শিক্ষিকা গৌরী বেরা, অনামিকা অট্ট প্রমুখ। তাঁরা তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী রুবিনা খাতুনের উদাহরণ তুলে ধরেন। রুবিনার বাবা দিনমজুর। মাস দুয়েক আগে একদিন দুপুরে হঠাৎই রুবিনার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। রুবিনা স্কুলে এসে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকাকে জানায়, তার ভাঁড়ের টাকা পেলে মাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। রুবিনা এই সময় অনলাইনকে বলে, ‘এই টাকায় মাকে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম।’

    স্কুলে আছে, ‘কানে কানে বলো’ নামে একটি বাক্সও। ছাত্রছাত্রীরা চিঠি লিখে তাদের মনের কথা বলে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা তা পড়েন। সমস্যা থাকলে সমাধান করার চেষ্টা করেন। এ জন্য প্রয়োজনে কখনও ডাক পড়ে অভিভাবকদেরও। ছাত্রছাত্রীদের মন ভালো রাখার জন্য, সুশিক্ষা দিতে স্কুলে সবজির বাগান বা কিচেন গার্ডেন ছাড়াও ফলের বাগান, ভেষজ উদ্যান গড়ে তোলা হয়েছে। গরমে পাখিদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য বাগানের গাছগুলিতে জলের পাত্র ঝোলানো হয়েছে।

    তৈরি হচ্ছে বিহান নামের স্মার্ট ক্লাসরুম। সেখানে প্রজেক্টরে পড়ানো হবে। স্কুলের এমন শ্রী দেখে প্রচুর উপহারও আসে। কেউ টেলিভিশন, কেউ চেয়ার, সোফা, দোলনা উপহার দেয়। প্রধান শিক্ষিকাও তাঁর শিক্ষারত্নের অর্থমূল্য পুরোটাই স্কুলকে দিয়েছেন।

    মেদিনীপুর জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের চেয়ারম্যান অনিমেষ দে বলেন, ‘সম্প্রতি স্কুল ছুটি পড়ে যাওয়ার পর পশ্চিম মেদিনীপুরের এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তরফে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সামার ক্যাম্প করা হয়েছিল। আমিও গিয়েছিলাম। এই স্কুলের শিক্ষা উপকরণ, শ্রেণিকক্ষ-সহ নানা বিষয়গুলি আমরা মডেল হিসেবে তুলে ধরতে চাই। সেই উদ্যোগ আমরা নিয়েছি।’

  • Link to this news (এই সময়)