এই সময়: আন্দোলনরত চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রতি সহানুভূতি থাকলেও আন্দোলনেরও একটি লক্ষ্মণ-রেখা রয়েছে বলে মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর বক্তব্য, আন্দোলনের নামে বিকাশ ভবন অবরোধ করে সরকারি কর্মীদের বাধা দেওয়া কিংবা রাস্তা অবরোধ করে সাধারণ মানুষের যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি করা যায় না। শিক্ষকদের আন্দোলনে বহিরাগতরা ঢুকে এই অবরোধ, বাধা দেওয়ার কাজ করছেন বলেও তাঁর কাছে খবর রয়েছে, দাবি মমতার।
বিকাশ ভবনের সামনে চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলন কখনও কখনও হিংসাত্মক হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও। প্রতিবাদের এই ধরন নিয়ে অভিষেকেরও আপত্তি রয়েছে।
সোমবার দিল্লি যাওয়ার পথে কলকাতা বিমানবন্দরে অভিষেক বলেন, ‘আমি আন্দোলনকারীদের কাছে একটাই অনুরোধ করে বলব, আন্দোলন কখনই হিংসাত্মক হয় না। আমি কিছু ভিডিয়ো ফুটেজ দেখেছি, যেখানে জোর করে গেট ভেঙে ফেলা হচ্ছে। আন্দোলন কখনই উগ্র হয় না, হিংস্র হয় না।’ এই প্রসঙ্গে রাজ্যের দাবি নিয়ে দিল্লি অথবা কলকাতায় রাজভবনের সামনে তৃণমূল কী ভাবে আন্দোলন করেছিল, তার উদাহরণ দিয়েছেন অভিষেক।
আন্দোলনরত শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীদের কর্মস্থলে ফিরে যেতে সোমবার ফের বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। যদিও বিকাশ ভবনের সামনে থেকে অবস্থান তুলে নিয়ে কর্মস্থলে ফেরার কোনও ইঙ্গিত দেননি শিক্ষকেরা।
উত্তরবঙ্গ সফরের পথে সোমবার কলকাতা বিমানবন্দরে চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে মমতা বলেন, ‘যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের সম্পর্কে আমাদের কোনও অভিযোগ নেই। আমার অভিযোগ একটাই, কাউকে জোর করে আটকে রাখা যায় না। রাস্তা অবরোধ করে মানুষের ক্ষতি করা যায় না। এতে বাইরের লোকেরা আছে। শিক্ষককের সংখ্যা কম, বাইরের লোকের সংখ্যা বেশি।’
এই বহিরাগতদের উপস্থিতির কারণেই বৃহস্পতিবার বিকাশ ভবনের সামনে অশান্তি হয়েছিল বলে দাবি নবান্ন–রও। অভিযোগ, অফিস–টাইম পেরিয়ে গেলেও সরকারি কর্মীরা সে দিন দপ্তর থেকে বেরোতে পারেননি। বিকাশ ভবন থেকে বেরোতে গিয়ে জখম হয়েছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে।
আন্দোলনরত শিক্ষকদের সরাতে সে দিন বেধড়ক লাঠিপেটা করে পুলিশ। জখম হন অনেকে। পরে রাজ্য পুলিশের দাবি, সে দিনের সেই পরিস্থিতিতে ‘যতটুকু’ প্রয়োজন ‘ততটুকু’ বলপ্রয়োগ করতে হয়েছিল।
সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর কথাতেও গত বৃহস্পতিবারের বিশৃঙ্খলার কথা উঠে এসেছে। তার প্রেক্ষিতেই মমতা বলেন, ‘মেয়েরা বলেছে, প্রেগন্যান্ট মাদারকে বাড়ি যেতে দিচ্ছে না। অফিসে যে কাজ করছে তাকে ১৪ ঘণ্টা, ১৮ ঘণ্টা, ২০ ঘণ্টা আটকে রেখে দেওয়া হচ্ছে।
একটি মেয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছে, বেরোতে দেওয়া হয়নি, সে ভয়ে লাফ দিয়েছে। তার পায়ে চোট আছে। সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আমি আন্দোলনের বিপক্ষে নই। কিন্তু আন্দোলন করার একটি লক্ষ্মণ রেখা আছে। আমার যেমন অধিকার নেই কাউকে বাধা দেওয়ার, অন্যেরও অধিকার নেই আমাকে বাধা দেওয়ার।’
‘যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চ’–র তরফে চিন্ময় মণ্ডলের বক্তব্য, ‘আমরা সঠিক ভাবেই লক্ষ্মণরেখা বজায় রেখে আন্দোলন করছি। সামান্য গেট অতিক্রম করে ঢোকাকে উনি (মমতা) ‘হিংসা’ ও ‘ধ্বংস’ — এ সব কথা বলেছেন!
বিনা কারণে ১৯ হাজার যোগ্য শিক্ষক–শিক্ষাকর্মীর চাকরি চলে গেল, এতগুলি জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেটা কি ধ্বংস নয়?’ অবস্থানে বসে থাকা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের পরিজনদের বহিরাগত তকমা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন চিন্ময়।
রাজ্য সরকার এই জটিলতা কাটাতে সব রকম চেষ্টা করছে বলে এ দিন মমতার পাশাপাশি শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুও চাকরিহারা শিক্ষকদের আশ্বস্ত করেছেন। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন ফাইল করেছে। এই পরিস্থিতিতে বিচারব্যবস্থার প্রতি শিক্ষকদের আস্থা রাখা উচিত বলে অভিষেক–ও মনে করছেন।
আন্দোলনরত শিক্ষকদের একাংশ আর পরীক্ষায় বসতে নারাজ। রাজ্যের ব্যাখ্যা, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে এই দাবি মানা নবান্নর পক্ষে সম্ভব নয়। মমতার কথায়, ‘কোর্ট যদি কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে আমি বলতে পারি না যে আমি মানব না। কারণ কোর্টের সিদ্ধান্ত মানতে আমরা বাধ্য।’ এই প্রসঙ্গে ব্রাত্য বলেন, ‘ওঁরা পরীক্ষা দিতে চান না। এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রয়েছে। কোর্ট যা বলেছে তাকে অবমাননা কী করে করব?’
বিকাশ ভবনের সামনে কয়েক হাজার শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী আন্দোলন করলেও প্রায় আড়াই–তিন হাজার শিক্ষক চিঠি লিখে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করার বার্তা দিয়েছেন বলে ব্রাত্য এ দিন জানিয়েছেন। এই শিক্ষকদের স্বাক্ষর করা চিঠিও সংবাদমাধ্যমকে দেখান তিনি। অন্যদিকে অবস্থানে যে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীরা বসে রয়েছেন, তাঁরা এতদিনেও রাজ্য সরকারের সঙ্গে লিখিত কোনও কমিউনিকেশন করেনি বলে ব্রাত্যর দাবি।