বাঁকুড়ার বাসিন্দা কেশ দম্পতি চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষকদের আন্দোলনে নিয়মিত মুখ। সোমা এবং তাঁর স্বামী উজ্জ্বল কেশ দু’জনই ২০১৬–র এসএসসির প্যানেলভুক্ত শিক্ষক। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি যাওয়ার পর থেকে দেড় মাস ধরে লাগাতার রাস্তায় আন্দোলনে রয়েছেন।
দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তাঁরা কাটাচ্ছেন রাস্তাতেই, তা সে ওয়াই চ্যানেল হোক বা বিকাশ ভবন। সোমা এবং উজ্জ্বলের তিন বছর সন্তান অভীপ্সা অন্ত্রের একটা জটিল অসুখ রয়েছে। যাকে ডাক্তারি পরিভাষায় বলে অ্যালার্জিক কোলাইটিস। এর জন্য হায়দরাবাদ, চেন্নাই, কলকাতা কোথায় না যেতে হয়েছে এই দম্পতিকে।
এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে আট লক্ষ টাকা খরচও হয়েছে। আরও খরচ বাকি। এই অবস্থায় হঠাৎ চাকরি খুইয়ে আতান্তরে ওই দম্পত্তি। চাকরি ফেরতের দাবিতে প্রতিটি ধর্না, প্রতিটি অবরোধে তাঁরা অংশ নিচ্ছেন। মেয়ে বাড়িতে প্রায় একা। দেখভালের জন্য সোমার মা রয়েছেন, তবে অভীপ্সাকে নিয়মিত ওষুধ দেওয়া, খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ওই প্রবীণাকে বেজায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
রাতের পর রাত মাকে কাছে না পেয়ে ছোট্ট অভীপ্সা খাওয়া–দাওয়াই করতে চাইছে না। ঘুমোচ্ছেও না। সারাদিন মায়ের কথা ভেবে মন খারাপ। সোমা বলছেন, ‘স্কুলে যাওয়ার আগে আর স্কুল থেকে ফিরে মেয়েই আমার কাছে সব। ওরও আমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না। আন্দোলনের মধ্যেও ভিডিয়ো কলে কথা বলি। তাতে ওর কান্না আরও বেড়ে যায়!’
সোমা একাই নন। চাকরিহারা ‘যোগ্য’ শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের আন্দোলনে এমন মা আরও অনেক রয়েছেন। নিশ্চিত জীবন ছেড়ে যাঁদের দিন–রাত এক করে হকের চাকরি ফেরানোর আন্দোলনে থাকতে হচ্ছে। মায়েদের মতো এখানে বাবারাও আছেন ঠিকই, কিন্তু ছোট ছোট সন্তানেরা যেখানে বেশির ভাগই মা–নির্ভর, সেই খুদেদের দিন–রাত কাটছে না ঘুমিয়ে, না খেয়ে, কাঁদতে কাঁদতে।
দিঘার রেহানা বেগমের কথাই ধরা যাক। তাঁক দু’টি মেয়ে। বড় মেয়ের বয়স ৫ বছর, ছোটটির ৩। চাকরিসূত্রে একাদশ–দ্বাদশের সংস্কৃতের শিক্ষক রেহানা থাকেন দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। স্বামী ছোটখাটো ব্যবসায়ী। রেহানার সঙ্গেই মেয়েদের যাবতীয় ওঠা–বসা। গত চার পাঁচ দিন ধরে লাগাতার তিনি বিকাশ ভবনের সামনের রাস্তাতেই রয়েছেন।
এর আগেও নানা আন্দোলনে তিনি ছিলেন। ফলে সব কেমন যেন রাতারাতি পাল্টে গিয়েছে। রেহানা বলছেন, ‘বড় মেয়েটা তবু কিছুটা বুঝতে শিখেছে। তাই ওকে বুঝিয়ে বলি। আমাকে না পেয়ে ওরও বুক ফেটে যাচ্ছে। কথা কম বলছে। তবে ছোটটার অবস্থা খুব খারাপ। মা কোথায় মা কোথায় বলে খাওয়া–দাওয়া, ঘুম সব বন্ধ করে দিয়েছে। ওকে ফোন করি না। করলেই খুব কাঁদে।’
বড়িষা গার্লস হাইস্কুলের চাকরিহারা শিক্ষিকা সালমা পারভিন মল্লিকের বছর পাঁচেকের মেয়েও রাতে ঘুমোচ্ছে না। সে আন্দোলনে থাকা মাকে মাঝে মধ্যেই ফোন করে জিজ্ঞাসা করছে, ‘চাকরিহারা মানে কী গো?’ ‘আচ্ছা, যোগ্য–অযোগ্য মানে কী?’ সালমা বলছেন, ‘কী উত্তর দেব বলুন? আমার কাছে কোনও উত্তর নেই। ওকে আমার মা যতটা পারছে দেখছে। কিন্তু মায়েরও বয়েস হয়েছে। নার্ভের ওষুধ খান। মেয়ে খাওয়া–দাওয়া প্রায় করছেই না। পড়তে বসাও বন্ধ। জানি না কী হবে!’
বাঁকুড়ার আর এক শিক্ষিকা সুপ্রীতি অট্টও তাঁর তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে খুবই চিন্তিত। তাঁর কথায়, ‘ও ছোট থেকে একটা বাঁধা রুটিনে অভ্যস্ত। বিকেলের মধ্যে মা ফিরে আসবে। তারপর থেকে আমার সঙ্গেই ওর সব কিছু। এখন সেই রুটিন ভেঙে গিয়েছে। মেয়ে অভিমান করছে। ঠিক মতো কথাও বলছে না।’
চাকরিহারারা জানাচ্ছেন, শুধু মায়েরাই নন, বাবাদের জন্যও উৎকণ্ঠাতেই দিন কাটছে সন্তানদের। এমনও অনেক সন্তান–সম্ভবা শিক্ষিকাও আছেন, যাঁরা সব রিস্ক ভুলে রাতের পর রাত খোলা রাস্তাতেই কাটাচ্ছেন। অনেক মা বাচ্চাদের সঙ্গেও নিয়েও আন্দোলনে থাকছেন।
মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের কথায়, ‘মাদারিং বা মাতৃত্ব আসলে কেয়ার গিভিংয়ের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ বাড়িতে ওদের দেখভাল কে করছে। মা বা বাবা বাচ্চার যেই এই কাজটা করুন না কেন, তাঁরা যদি অনেকটা সময়ে ওদের ধরা–ছোঁয়ার বাইরে থাকেন, তাহলে সেই শিশুদের অবসাদ হওয়াটা স্বাভাবিক। সারাক্ষণই সে মাকে খুঁজবে। খুঁজে না পেলে বিরক্ত হবে।’ তাই মায়েদের বাচ্চাদের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া এই ক্রাইসিস থেকে মুক্ত হওয়ার খুব রাস্তা নেই বলেই জানাচ্ছেন নীলাঞ্জনা।