জেলের বাগানে কাজ করছেন আরজি কর-কাণ্ডে দোষী সঞ্জয়, একদা দাপুটে সিভিকের দৈনিক আয় কত? কেমন কাটছে দিন?
আনন্দবাজার | ২০ মে ২০২৫
নীল-কালো বাইকের উপর ইংরেজি হরফে বড় বড় করে লেখা ‘পুলিশ’। সেই বাইক নিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়াতেন ৫৫বি, শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিটের বাসিন্দা সঞ্জয় রায়। পেশায় কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার। আরজি কর থেকে শুরু করে এনআরএস— সরকারি হাসপাতালে ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত, অশেষ দাপট। যে দাপটে ভর করে ৮ অগস্ট মধ্যরাতে তিনি আরজি কর হাসপাতালের চার তলায় উঠে সটান ঢুকে পড়েছিলেন সেমিনার হলে। সে দিন রাতের ডিউটিতে কর্তব্যরত চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা ঘটেছিল। যে ঘটনায় সঞ্জয়ের দোষ আদালতে প্রমাণিত। দাপুটে সিভিক এখন গরাদের ওপারে।
আরজি কর-কাণ্ডে সঞ্জয়কেই একমাত্র অভিযুক্ত হিসাবে চার্জশিটে উল্লেখ করেছিল তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। মূল ঘটনার ১৬৪ দিনের মাথায় ২০ জানুয়ারি তাঁকে আজীবন কারাবাসের নির্দেশ দেওয়া হয়। যাবজ্জীবন কারাবাসের সবে চার মাস কেটেছে। জানুয়ারির ২০ তারিখে তাঁকে শাস্তি দিয়েছিল আদালত। মঙ্গলবার মে মাসের ২০ তারিখ। চার মাস কী ভাবে কাটল সঞ্জয়ের? খোঁজ নিয়েছে আনন্দবাজার ডট কম।
প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে রয়েছেন সঞ্জয়। সূত্রের খবর, জেলে আপাতত তাঁকে বাগান পরিচর্যার কাজে নিয়োগ করা হয়েছে। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় বাগানেই কাটছে তাঁর। জেলের নিয়ম অনুযায়ী সঞ্জয়ের দৈনিক মজুরি এখন ৮০ টাকা। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েক জন কয়েদি ওই কাজ করছেন। পরে সঞ্জয়ের ‘কর্মদক্ষতা’ বিবেচনা করে তাঁকে অন্য কাজ দেওয়া হতে পারে।
আপাতত সঞ্জয়ের ঠিকানা প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের ৬ নম্বর সেল। বাগানের পাশাপাশি নিজের সেলটি পরিচ্ছন্ন রাখাও তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে। জেলের খাতায় সঞ্জয় আপাতত ‘আনস্কিল্ড’। কাজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কয়েদিদের আরও দু’টি পর্যায় রয়েছে— ‘সেমি স্কিল্ড’ এবং ‘স্কিল্ড’। তিন ক্ষেত্রে মজুরিও ভিন্ন। ‘সেমি স্কিল্ড’ কয়েদিরা দৈনিক ৯০ টাকা এবং ‘স্কিল্ড’ কয়েদিরা দৈনিক ১০০ টাকা মজুরি বাবদ পান। সাধারণত যাঁরা দীর্ঘমেয়াদি সশ্রম কারাদণ্ড পান, জেলে তাঁদের এই ধরনের কাজ এবং রোজগারের সুযোগ দেওয়া হয়। প্রাথমিক ভাবে জেল কর্তৃপক্ষ প্রথম তিন মাস কয়েদিদের পর্যবেক্ষণ করেন। তার পর তাঁদের জন্য কাজ বরাদ্দ করা হয়। কাজের ধরন, কয়েদির আচরণ বিবেচনা করে শাস্তির মেয়াদ মাস প্রতি সর্বোচ্চ চার দিন পর্যন্ত কমতে পারে।
বাগান পরিচর্যা করে অর্জিত অর্থ সঞ্জয় অবশ্য হাতে হাতে পাচ্ছেন না। মজুরি ঢুকছে তাঁর নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। রোজগারের সম্পূর্ণ টাকা তিনি এখন খরচও করতে পারবেন না। নিয়ম অনুযায়ী, মোট রোজগারের ৫০ শতাংশ জেলে থাকাকালীন নিজের বিবিধ প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারেন কয়েদিরা। বাকি টাকা প্রয়োজন হলে অনুমতিসাপেক্ষে তাঁদের পরিবারকে দেওয়া হয়। অথবা কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হলে সম্পূর্ণ টাকা তুলে দেওয়া হয় ওই কয়েদির হাতে। সঞ্জয়ের ক্ষেত্রে মজুরির টাকা আপাতত তাঁর অ্যাকাউন্টেই থেকে যাচ্ছে।
জেল সূত্রে খবর, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়ে সঞ্জয় যখন প্রথম প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে এসেছিলেন, তখন প্রায়ই মনমরা হয়ে থাকতেন। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না। খুব বেশি কাজও করতেন না। জেলের বাইরে যে জীবন তিনি যাপন করতেন, একটি রাতের ঘটনায় তা বদলে গিয়েছিল। কারণ, ঘটনার পরদিন থেকেই সঞ্জয় পুলিশ হেফাজতে। তার পরেও জেলেই। শাস্তি ঘোষণার পর তিনি জেলের আজীবন আবাসিক।
নিয়মিত বক্সিং করতেন সঞ্জয়। বেশির ভাগ সময়েই থাকতেন কলকাতা পুলিশের ৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের বি১৪কে ব্যারাকে। যে বাইক নিয়ে সঞ্জয় ঘুরে বেড়াতেন, সেটি কলকাতা পুলিশের ওয়েলফেয়ার সেলের বাইক। পদমর্যাদা অনুযায়ী ওই বাইক তাঁর পাওয়ার কথা নয়। খাতায়কলমে ব্যারাকে থাকার অধিকারও ছিল না। কিন্তু সঞ্জয় ‘প্রভাবশালী’ ছিলেন। যা চাই, প্রভাব খাটিয়েই তা আদায় করে নিতে পারতেন। কারা প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত অনেকে মনে করেন, জেলের দৈনন্দিন জীবনযাপনে শুরুর দিকে সেই প্রভাব ‘মিস্’ করছিলেন সঞ্জয়। তাই মনমরা দেখাত তাঁকে।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি পাল্টেছে। জেলে কিছুটা ‘স্বাভাবিক’ হয়েছেন আরজি করের ধর্ষক-খুনি। নিজের মতো কাজ করছেন। টুকটাক কথাও বলছেন। সকাল-সন্ধ্যা যাচ্ছেন বাগানে। শিয়ালদহ আদালতের রায়ের পর সঞ্জয়ের আইনজীবী জানিয়েছিলেন, উচ্চতর আদালতে আবেদন জানাবেন তাঁরা। এখনও সঞ্জয়ের দিক থেকে হাই কোর্টে তেমন কোনও আবেদন জমা পড়ার খবর নেই। একদা ‘প্রভাবশালী’ সিভিক আপাতত দৈনিক মজুরিতে খাটন দিচ্ছেন। নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছেন জেলের পরিবেশের সঙ্গে।