বছর ঘুরলেই বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে দলের সাংগঠনিক স্তরে রদবদল করেছে তৃণমূল। কাউকে ব্লক স্তর থেকে নিয়ে আসা হয়েছে জেলা স্তরে। আবার কারও পদই তুলে দেওয়া হয়েছে! যার ভিত্তি ‘পারফরম্যান্স’। সোমবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তেমনই জানিয়ে দিলেন। তাঁর কথায়, সংগঠনে রদবদলের সূচক একটিই— ‘পারফরম্যান্স’। গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল এবং সারা বছরের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড, দু’টি বিষয় পর্যালোচনার ভিত্তিতে দল পরিশ্রমীদের পুরস্কৃত করেছে। এতে অনুমোদন রয়েছে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
সোমবার দিল্লি গিয়েছেন অভিষেক। তার আগে তিনি বলেছেন, ‘‘রদবদল দলের সিদ্ধান্ত। আমরা বিভিন্ন স্তরে পর্যালোচনা করে এবং দলের মধ্যে সকলের সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তগুলি নিয়েছি। ব্লক থেকে জেলা স্তরে সকলের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। যেখানে যা পরিবর্তন হয়েছে, দলনেত্রীর অনুমোদনে হয়েছে।’’ প্রসঙ্গত, গত বছর ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে সংগঠনে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। জানিয়েছিলেন, রদবদলের ‘মাপকাঠি’ হবে লোকসভা নির্বাচনের ফলফল। দেখা গিয়েছে, লোকসভায় তৃণমূল হেরে যাওয়া অনেক আসনে জয় ছিনিয়ে এনেছে। তবে কোথাও কোথাও লোকসভা আসন জিতলেও সেখানকার বিধানসভা এলাকাগুলিতে পিছিয়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিক রদবদলেও তারই প্রভাব পড়েছে। অভিষেকের কথায়, ‘‘কে কোথায় থাকবেন, পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে তা ঠিক করা হয়েছে। যাঁরা সাংসদ হয়ে গিয়েছেন, তাঁদের জেলা স্তর থেকে সরিয়ে রাজ্য স্তরে আনা হয়েছে। কেউ সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, কেউ সহ-সভাপতি বা সম্পাদকের পদ পেয়েছেন। অনেককে আবার ব্লক স্তর থেকে জেলা স্তরে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। দলে সকলের ভূমিকাই পাল্টেছে।’’
শুধু লোকসভায় জয়ের ভিত্তিতে নয়, সার্বিক ভাবে পরিশ্রমের দামও দিয়েছে তৃণমূল। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অভিষেক বলেন, ‘‘যাঁরা হয়তো খুব চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সেই কেন্দ্রে আমরা আশানুরূপ ফল করতে পারিনি। তবে তাঁদের পরিশ্রমে খামতি ছিল না। তাঁদেরও পুরস্কৃত করা হয়েছে। যাঁরা দলের জন্য খেটেছেন, প্রাণপাত করেছেন, সারা বছর মানুষের কাছে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজগুলিকে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁদের সকলকে পুরস্কৃত করার চেষ্টা করেছে দল।’’
অভিষেকের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের বক্তব্য, তিনি ‘কাছের মানুষে’ বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করেন ‘কাজের মানুষে’। সাম্প্রতিক রদবদলে তার সবচেয়ে বড় প্রতিফলন ঘটেছে বীরভূমে। কারাবাসে থাকায় জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে লোকসভা ভোটের সময় পায়নি তৃণমূল। তবে তাঁর অনুপস্থিতিতেও বীরভূমের দু’টি আসনই তৃণমূল ধরে রেখেছে। এমনকি, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যে দুবরাজপুর কেন্দ্রে তৃণমূল হেরে গিয়েছিল, সেখানেও লোকসভা ভোটে তারা এগিয়ে রয়েছে। বীরভূমের এই সাফল্যের নেপথ্যে ছিল কোর কমিটি, যার সদস্য কাজল শেখ, শতাব্দী রায়, বিকাশ রায়চৌধুরীরা। রদবদলে বীরভূমের জেলা সভাপতির পদটিই তুলে দেওয়া হয়েছে। গুরুত্ব বেড়েছে কোর কমিটির, যার অন্যতম সদস্য হিসাবে রাখা হয়েছে অনুব্রতকে।
আবার জয় সত্ত্বেও রদবদলের অন্যতম নিদর্শন কলকাতা উত্তর। সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘ দিন এই সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ছিলেন। মাঝে এক বার মমতা তাঁকে সরিয়ে তাপস রায়কে সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু দলনেত্রীর কাছে দরবার করে আবার পদ আদায় করে নেন সুদীপ। তাঁর সঙ্গে সংঘাতের সূত্র ধরে তাপস বিজেপিতে চলে যান। জেলা সভাপতি হিসাবে সুদীপের ভূমিকা নিয়ে দলের অন্দরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। অভিযোগ, সারা বছর তাঁকে পাওয়া যায় না। কেবল ভোটের আগে নড়াচড়া করেন। আরজি করে ধর্ষণ-খুনের ঘটনার পর্বেও উত্তর কলকাতার জেলা সভাপতির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। ফলে নিজের আসনে জিতলেও সুদীপের পদে কোপ পড়েছে। বীরভূমের মতো উত্তর কলকাতাতেও জেলা সভাপতির পদ তুলে দিয়ে ন’জন সদস্যের কোর কমিটি গঠন করেছে তৃণমূল। যার চেয়ারম্যান সুদীপ। অভিষেক জানিয়েছেন, কিছু দিনের মধ্যেই ওই কোর কমিটির বৈঠক হবে। তাঁর মতে, ‘‘সকলে মিলেই সংগঠনের কাজ করবেন। কার ক্ষমতা খর্ব হল, কাকে বেশি পুরস্কৃত করা হল, এ ভাবে বিষয়টা দেখা ঠিক নয়।’’
‘পারফরম্যান্স’ নীতির প্রতিফলন ঘটেছে হুগলি, হাওড়া, ঘাটালের সংগঠনেও। ২০১৯ সালে হুগলির লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল। এ বার সেই আসন ছিনিয়ে এনেছে তৃণমূল। এই পর্বে শ্রীরামপুর হুগলির সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ছিলেন অরিন্দম গুঁইন। তিনি পরিশ্রমের ‘পুরস্কার’ পেয়েছেন। পদে বহাল রাখা হয়েছে তাঁকে। একই ভাবে ঘাটাল সাংগঠনিক জেলার সভাপতি বদল করেছে তৃণমূল। দাসপুরের নেতা আশিস হুদাইতকে সরিয়ে পিংলার বিধায়ক অজিত মাইতিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি ছিলেন অবিভক্ত পশ্চিম মেদিনীপুরে তৃণমূলের জেলা সভাপতি। ২০১৯-এর ভোটে মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামে তৃণমূলের ভরাডুবি হয়েছিল। কিন্তু ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনেই এই অঞ্চলে ঘুরে দাঁড়ায় শাসকদল। ফলে জেলা সভাপতি হিসাবে অজিতের মার্কশিট আগেই লেখা হয়ে গিয়েছিল। পরে তৃণমূল পশ্চিম মেদিনীপুরকে দু’টি সাংগঠনিক জেলায় ভাগ করে— মেদিনীপুর এবং ঘাটাল। ঘাটালের সভাপতির বিরুদ্ধে নানাবিধ অভিযোগ আসছিল। জেলা সভাপতি না-হওয়া সত্ত্বেও লোকসভা ভোটের আগে অজিতকে সেখানে ‘বিশেষ দায়িত্ব’ দেওয়া হয়েছিল। দেখা যায়, ঘাটাল ধরে রেখেছে তৃণমূল। সেই সঙ্গে ছিনিয়ে নিয়েছে মেদিনীপুরও। তার পুরস্কার পেয়েছেন অজিত।
হাওড়া সদর সাংগঠনিক জেলার সভাপতির পদ থেকে কল্যাণ ঘোষকে সরিয়ে সেই জায়গায় আনা হয়েছে উত্তর হাওড়ার বিধায়ক গৌতম চৌধুরীকে। লোকসভা নির্বাচনে জিতলেও হাওড়ার ক্ষেত্রে তৃণমূলের কিছু সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়ে গিয়েছিল। কল্যাণের বিরুদ্ধে দলের একাংশের বক্তব্য ছিল, তিনি সকলকে নিয়ে চলতে পারছেন না। ফলে সারা বছরের সাংগঠনিক কাজ এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেয়েছে। হাওড়ার চেয়ারম্যানও বদল করে দিয়েছে তৃণমূল। প্রাক্তন সিপিএম নেতা লগনদেও সিংহকে সরিয়ে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মন্ত্রী অরূপ রায়কে। লগনদেওকে ‘সাম্মানিক’ হিসাবে রাজ্য সংগঠনের সম্পাদক পদ দেওয়া হয়েছে। হাওড়া লোকসভা ভোটে তৃণমূল শুধু জেতেনি, সাতটি বিধানসভাতেই তারা এগিয়ে ছিল। তবু কেন রদবদলে এই জেলাকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হল? দলের এক প্রবীণ নেতার কথায়, ‘‘হাওড়া শহর এলাকা বিজেপির জন্য উর্বর মাটি। কারণ, শহর হাওড়ায় শিবপুর, দক্ষিণ হাওড়া, মধ্য হাওড়া, উত্তর হাওড়া, বালি— এই সমস্ত জায়গায় বিপুল সংখ্যক অবাঙালি ভোটার রয়েছেন। ফলে এখানে বিজেপি সহজেই সাংগঠনিক জায়গা খুঁজে নিতে পারে। ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সেই সম্ভাবনাও রুখে দিতে চাইছে তৃণমূল।’’